পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৫০

মুহূর্তে ঘরে ঢুকলাম; কিন্তু আমার ঘরের দরজা লাগাবার সাহস হলো না যদি শব্দ হয়ে যায়। এর অল্প পরই সৈন্য দুটো চলে গেল পাশের পশ্চিম দিকে একতলার ফ্ল্যাটের পেছনে, সম্ভবতঃ ওদিককার দরজা খুলে ফেলার আওয়াজ শুনে। আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

 মৃত্যু আসন্ন মনে হলো, আমরা সকলে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। ততক্ষণে আমাদের দরজায় লাথি মারা থেমেছিল কিন্তু আবার শুরু হলো ‘খোল খোল’ আর লাথি। ভারী বুটের দুড়দাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার শব্দের মাঝে জোরে শুনতে পেলাম মনিরুজ্জামান সাহেবের গলার আওয়াজ-লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। চার-পাঁচবার শুনতে পেলাম উনার কালেমা পড়ার শব্দ, তারপর হঠাৎ থেমে গেলেন যেন।

 বাইরে চারিদিকে গোলাগুলীর আওয়াজ-এর পরই আমাদের বাইরের দরজার উপর গুলী হলো, আর কয়েকটা বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে এলো। ১২/১৪ রাউ- গুলীর শব্দ শুনলাম। মনে হলো, মেরে ফেললো- মরে গেল মানুষ। রাত তখন দেড়টা। তারপর আমাদের বিল্ডিং-এ সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মিনিট দশেক পরে শুনলাম ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরদার চীৎকার, ‘বাসন্তী দোলা।’ তিনি স্ত্রী ও মেয়ের নাম ধরে ডেকে উঠেছিলেন। বিল্ডং-এর সামনে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল।

 উনি ঘাসের উপর পড়েছিলেন। ডঃ জ্যোতির্ময় ২৫শে মার্চের পরও কয়েকদিন জীবিত ছিলেন এবং ২৭শে মার্চের সকালে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে নেয় হয়। মনিরুজ্জামান সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিল মিলিটারীর বুটের ধাক্কায়। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর বোন, জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শুনে পানি নিয়ে নীচে নামছিলেন। তাঁরা তিনতলা থেকে আর্মিদের চলে যেতে দেখেছেন এবং তখনো বুঝতে পারেননি যে নীচে তাঁদের বাড়ীর লোকজনদের একতলার দরজার উপর হত্যা করা হয়েছে।

 মনে করেছিলেন এরেষ্ট করে নিয়ে চলে গেল। নীচে নামতেই দেখতে পেলেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। মনিরুজ্জামান সাহেবের ষোল বছরের ছেলের তখন অন্তিম মুহূর্ত। সে কষ্টে বলেছিল ‘মা পানি দাও’। মুখে পানি দেবার পর সে এক মুখ পানি নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ছেলের পাশে পড়ে ছিলেন মনিরুজ্জামান সাহেব, তাঁর প্রায় ৩০ বছর বয়স্ক ছোট ভাই এবং ১৪ বছরের ভাগ্নেটি। এই চারজন শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেয়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী জ্যোতির্ময় বাবুর মুখে পানি দেন।

 পূর্ব দিকের দোতলায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দেখতে পান আর্মি চলে গেছে এবং জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শোনা গেল বিল্ডিং-এর সামনে ঘাসের ওপর থেকে। তখন রাজ্জাক সাহেব বাসা থেকে একজন লোক নীচে নামতে যেয়ে দোতলার দরজায় এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ঘরে ঢুকে পড়ে। এরপর রাজ্জাক সাহেব তাঁকে নিয়ে নীচে নেমে আসেন। এ সময় জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রী, সারভেণ্ট কোয়ার্টার থেকে তাঁর ড্রাইভারকেও ডেকে এনেছিলেন।

 তাঁরা কয়েকজন ধরাধরি করে পশ্চিম দিকের একতলায় জ্যোতির্ময় বাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ঠিক এই সময় আবার বিল্ডিং এর গেটের কাছে আর্মি এসে পড়ে। এর আগেই রাজ্জাক সাহেব দোতলায় তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন এবং সকলেই দরজা বন্ধ করে ফেলেন। বাড়ীর বাগানে বেরুবার পেছন দিকের দরজা দিয়ে সৈন্যরা জ্যোতির্ময় বাবুর ফ্ল্যাটে ঢোকে এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ কথা তাঁর কাছ থেকে শোনা। ২৭শে মার্চ জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে মেডিক্যালে দেখা হয় এবং তাঁকে সাথে করে ডঃ জ্যোতির্ময় বাবুর বেডের পাশে যেয়ে দাঁড়াই।

 দেখেছিলাম তাঁর ঘাড়ের কাছে গুলি লেগে এদিক থেকে ওদিক দিয়ে বেরিয়েগেছে এবং ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। জ্ঞান সম্পূর্ণ ছিল এবং খুব ভালোভাবে তখন আমার সাথে কথা বলছিলেন। মনের জোর