পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৫১

তখনো অটুট ছিল। বলেছিলেন, রাইট সাইডটা পেরালাইজড কিন্তু বেশ বহাল তবিয়েতেই আছি। উনি বলেছিলেন যে নাম জিজ্ঞাসা করার পরই তাঁকে গুলী করা হয়। এরপর আরম্ভ হলো আমাদের বিল্ডিং-এর উত্তর দিকে প্রায় বিশ গজ দূরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোষ্টের বাড়ীর দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা।

 ‘খোল খোল, দরজা খোল’-আর দরজায় লাথি, ধাক্কা। কিছুক্ষণ চললো, তারপর থেমে গেল। তারা বাকী রাত্রিটুকুর মধ্যে ওখানে পুরনো দিনের মজবুত দরজা খোলার আরো দুবার চেষ্টা চালায়। চারদিকে অনবরত গুলীর শব্দ। ভোর হলো। থেকে থেকে আশপাশে গুলীর শব্দ হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনারের কাছে একটা ক্ষীণ মাইক দিয়ে এক অবাঙ্গালী বাংলাতে বললো, 'আপনারা বাড়ীর বাইরে বেরুবেন না, আপনাদের ঘেরাও করা হয়েছে। মেঝেতে শুয়ে নিজে নিজে মনে করলাম হয়ত কারফিউ-এর বাংলা তরজমা করতে যেয়ে ‘ঘেরাও’ বললো। মনকে প্রবোধ দিলাম, কারফিউ-এর কথাই হয়ত বলছে। এর ঘণ্টাখানেকের পর এত ঘণ্টার পরিচিত গোলাগুলির আওয়াজের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে শহীদ মিনারের কাছে একটা জোর শব্দ হলো। মনে হলো হাত বোমা।

 অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরে বারুদের গন্ধ ভেসে আসলো, দরজার নীচে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে পোড়া কাপড়ের মত ছাই উড়ে এসে পড়তে লাগলো। এ হাত বোমার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছিল পালিয়ে যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই ধলেশ্বরী নদীর ওপারে এক লোকের কাছ থেকে। সে আমাকে গ্রামে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কারণ সেও অনেকের মত শুনেছিল, ‘প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের ফ্যামিলির সকলেই ওই বিল্ডিং-এ ২৫শে মার্চের রাত্রে মারা গেছে। এই লোকটি হলো হাশেম। আমাদের ৩৪ নম্বর বিল্ডিং-এর পূর্বদিকের তিনতলার ফ্লাটে জার্মান প্রফেসর ওয়াণ্টার শোয়েপ্পির সে বাবুর্চি ছিল। তার জীবনের চরম মুহূর্তে সেই ২৫শে মার্চের রাতেই কেটে গেছে। তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিল অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, ভাই, ভাগ্নের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর্মি অফিসার গুলী করার হুকুম দিতেই গুলীর পূর্বক্ষণে সে চীৎকার দিয়ে পড়ে যায়.... তার পরই কতক গুলো গুলী হয়ে গেছে- তার শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়েছে অন্যেরা।

 গুলী শেষ করে বর্বর পশুরা মৃত দেহের উপর লাথি মেরেছিল এবং হাশেমের কোমরে বুটের প্রচণ্ড বাড়ি মারে। তারপর তারা সেখান থেকে সরে যেতেই হাশেম উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে তিনতলায় যেয়ে দরজা বন্ধ করে। তার সমস্ত জামায় রক্ত লেগে গেছে, সে বুঝতে পারছিল না তার কোথায় গুলী লেগেছে। জামা খুলে হাশেম তার শরীরটা পরীক্ষা করে দেখে যে গুলী লাগেনি। আমি হাশেমকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল যে সে ঘুমকাতুরে এবং যখন দরজায় কলিংবেল বাজায়, মাত্র তখন তাঁর ঘুম ভাঙ্গে এবং আমরা কেউ বেল বাজাচ্ছি মনে করে সে ঘুমের ঘোরে দরজা খোলে।

 খুলতেই সেনাবাহিনীর লোক সাক্ষাৎ জমদূতের মতো মধ্য বয়সী গোলমাল হাশেমের জামার কলার চেপে ধরে বলে-'তোম প্রফেসর হো?’ হাশেম বলে উঠে, জার্মান সাবকা নওকর হুঁ। নিমেষে তাদের কয়েকজন ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। যে তার কলার ধরেছিলো সে পকেটে হাত দিয়ে বলে, “জয় বাংলাকা ফোটো হ্যায়?’ তার পকেটে কয়েকটা বেতনের একশ’ টাকার নোট ছিল। জার্মান প্রফেসর হাশেমকে তার আগামী তিন মাসের বেতন দিয়ে ব্যাঙ্কক চলে গিয়েছিল।

 নোটগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় মেঝেতে। বলে শালা তোম রূপিয়ে লেকে কেয়া করোগে, আভি তোমকো গুলী করেঙ্গে'। বলেই হিড় হিড় করে ওকে নীচে নামিয়ে আনে এবং দুজন ওকে ধরে রাখে। এর পরই সে দেখতে পায় মনিরুজ্জামান সাহেব এবং তাঁর বাসার অন্যান্যদের ধরে নিয়ে আসতে। শাস্ত্রধারী মনিরুজ্জামান সাহেব উচ্চস্বরে কলমা পড়ছিলেন-এমন সময় উনাকে চপেটাঘাত করে এক পঞ্জাবী সৈন্য। এর পর মুহূর্তে গুলী করা হয়!