পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৫২

 সেই হাশেম যখন মৃত্যুর হাত থেকে ছুটে এসে দম ফেলেছিল তখন আবার শুনতে পায় বিল্ডিং-এ মিলিটারী আসার শব্দ। এর কিছু পরে কে যেন তার ফ্ল্যাটের দরজায় কাতরাতে থাকে। ও মনে করেছিল হয়ত এ বিল্ডিং-এর কেউ আহত অবস্থায় দরজার কাছে এসেছে। সিঁড়িতে আলো জ্বলছিল। হাশেম কাঠের দরজার ছিদ্রপথে দেখে, এক সৈন্য অস্ত্র হাতে দরজার পাশে বসে অভিনয় করছে। হাশেম ছুটে বারান্দার প্রান্তে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাক সেনারা ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি। এ হাশেমের কাছ থেকেই তখনি শোনা, শহীদ মিনারের অভাবিত দৃশ্যের কথা।

 বেলা তখন দশটার মত। হাশেম বলে চললো, আমি লুকিয়ে তিনতলা থেকে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখছি-চারজন পাঞ্জাবী সৈন্য শহীদ মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে মুখ করে আছে-এমন সময় কি হয়ে গেল সেখানে বোমা ফেটে গেল, হাতবোমা। ধোঁয়া, আর শহীদ মিনারের পেছন দিকে দুটো লোক ছুটে পালিয়ে গেল। দেখা গেল সে মুহূর্তে দুজন সৈন্য শহীদ মিনার থেকে মেডিক্যাল কলেজের মোড়ের ট্রাফিক লাইটের দিকে দৌড়ে পালালো। কয়েক মিনিট পরেই এলো একটা গাড়ী। শহীদ মিনারের ওপর পড়েছিল দুটো মিলিটারীর লাশ। সে গাড়ীটি মরা সৈন্য দুটোর অস্ত্রগুলো নিয়ে চলে গেল। কয়েক মিনিট পর আর একটি গাড়ী এলো এবং লাশ দুটোকে নিয়ে চলে গেল। সে দিন ছিল ২৬শে মার্চ, শুক্রবার শহীদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি-।

 যে, ২৬শে মার্চে শুক্রবার তাঁর ফ্ল্যাটে বার পাঁচেক পাক সেনারা ঢোকে এবং বলতে থাকে “আওর এক আদমী হ্যায় ও কিধার হ্যায়? উনারা জানান যে বড় পুরুষ মানুষ আর কেউ জীবিত নেই। তখণ তাঁরা সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজে এবং জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে। হয়ত এই অপর এক আদমী ছিল হাশেম। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ও হাশেম এই বিল্ডিং-এর তিনতলা থেকে জগন্নাথ হলের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে বহু মৃতদেহ সে গর্তে ফেলে দিতে দেখেছিলেন।

 রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গেও গ্রামে একদিন দেখা হয়, উনিও বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা বলেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ধরা গলায় বলেছিলেন, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিকেল বেলা আর্মি গেঞ্জী পরা ১২/১৪ বছরের চারটে ছেলে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান সাহেবের লাশ টানিয়ে নিয়ে গেল গর্তের ওখানে। তখন বোধ হয় আর লাশ মাঠে ছিল না। ছেলে চারটিকে গর্তের পাশে লাইন করে ওরা গুলী করেছিল।