পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৫৪

 ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমাণ্ডারের গলা। জানাচ্ছে দি বিগ ফিস হ্যাজ বিন কট। কার কথা বলেছে তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে বঙ্গবন্ধু বন্দী হয়েছেন। রেডিও শুনে চলেছি আর ঢেকে রাখা স্তিমিত আলোতে প্রধান তথ্যগুলো টুকে রাখছি। হঠাৎ কানে এলো আবার কণ্ট্রোলের গলা দেয়ার ইজ নো কোশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং এ্যাট ইউ। সো ওয়াইপ দেম অফ। কাউকে বন্দী করার প্রশ্ন ওঠে না ওরা তোমাদর গুলি করেছে। সুতরাং ওদের খতম করো। কথাগুলোয় মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগলো। তাহলে এই করছে পাক বর্বররা।

 এর প্রমাণ রাখতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে টেপরেকর্ডার এনে সোজাসুজি তার দিয়ে রেডিও সাথে লাগিয়ে দিলাম। এয়ারফোনের মাধ্যমে শুনতে লাগলাম। বাবা, মা, বাড়ীর সবাই তখন চারপাশে জড়ো হয়েছেন। মাঝে মাঝে জানালায় গিয়ে বাইরের দিকে খোঁজ নেয়া হয়-কেউ ওদিকে আসছে কি না। এরপর দুদিন ধরে প্রায় সারাটা সময়ই বাড়ীর কেউ না কেউ এয়ারফোন কানে ধরে বসে রয়েছে কি শোনা যায়। সবকিছু টেপ করা সম্ভব হয়নি। টেপ আছে ২৫শের রাত ও ২৬শের সকালের পাক সেনাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্ত্তার অংশ।

 অন্য তথ্য টেপে নেই, তবু যা আছে তা আজ এতদিন পরে শুনলেও মনে যে অনুভূতি জাগে, তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। বর্বরদের সে কি উল্লাস। বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা নামাতে হবে। রাস্তার ব্যারিকেড সরাতে হবে। এ কথা লাউড স্পীকারের মাধ্যমে প্রচার করার হুকুম দিল পাক কমাণ্ডার নেটিভ টাং এ্যাজ ওয়েল এ্যাজ ইংলিশ এণ্ড উর্দুতে। নেটিভ হচ্ছি আমরা অর্থাৎ বাঙ্গালীরা।

 আদেশ না মানলে কি করতে হবে তারও বিশদ হুকুম শুনলাম। আশপাশের লোক ধরে এনে তাদের মধ্যের কয়েকজনকে পুরস্কৃত করতে হবে। (কমাণ্ডারের ভাষায়) সে পুরস্কার হবে মৃত্যুদণ্ড। অন্যদের ফিরে যেতে দেয়া হবে যাতে ব্যাপারটা সবাই ভাল করে বুঝতে পারে। তাই সেই রাতে ঐ মুহূর্তেই নামিয়ে ছিলাম স্বাধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা। নামাতে বলেছিলাম প্রতিবেশীদের। সে পতাকা ফেলে দেইনি, নষ্ট করিনি। লুকিয়ে রেখেছিলাম ঘরে।

 পাক কমাণ্ডার আরো হুকুম দিল কিভাবে বাড়ীগুলির তল্লাশী করতে হবে। বাড়ীর সবাইকে বাইরে এনে দাঁড় করিয়ে ভেতরে খুঁজে দেখতে হবে ভাল করে। স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা সনাক্ত করতে সেসব ব্যক্তিদের যাদের আটক করার প্রয়োজন ইত্যাদি।

 ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমাণ্ডার-এতটুকু উত্তেজনা ছিল না কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম ঐ গলা ছিল বিগ্রেডিয়ার আরবীর খানের। ঐ গলায় আনন্দে বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন, সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কি সাংঘাতিক ক্রোধ ছিল পিপল-এর ওপর, ট্যাংকবিধ্বংসী কামান ব্যবহার করেছে পিপলস অফিসের উপর পাক সেনারা। এটি ছিল ২৬ নম্বর ইউনিট। পরে জেনেছি এর ইমাম' ছিল কর্ণেল তাজ। যার হেড কোয়ার্টার প্রেসিডেণ্ট হাউস।

 এই ২৬ নম্বর ইউনিট হত্যা করেছে লে: কমাণ্ডার মোয়াজ্জমকে। বলেছে, তাকে ধরতে যাওয়া হয়েছিল বাধা দেওয়ায় নিহত হয়েছে সে। ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে জীপের পেছনে দাড়িতে বেঁধে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার মৃতদেহ। এই ২৬ নম্বর ইউনিট আক্রমণ করেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। সবচেয়ে উল্লাস ছিল এই ২৬ নং ইউনিটেরই। তার বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে কর্ণেল তাজকে করা হয়েছিল- ডি,এস, এ,এম,এল-ডেপুটি অব এ্যাডমিনিস্ট্রেটর মার্শাল ল। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল। কণ্ট্রোল বলছে 'দ্যাট ইজ জলি গুড। দ্যাট ইজ একসেলেণ্ট। বা হি ইজ ইউজিং এভরিথিং হি হ্যাজ গট'।

 সেই এভরিথিং এ ছিল ট্যাংক, রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লান্সার ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ছিল পশ্চিম দিক থেকে রেল লাইন জুড়ে ৮১ নং ইউনিট। দক্ষিণ দিক থেকে ৮৮ নং ইউনিট ও উত্তর দিক থেকে