পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

HIV বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড ২৬ নং ইউনিট। বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও লিয়াকত হল থেকে। সবচেয়ে বেশী বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল থেকে। ২৬শে মার্চ সকালের দিকে কন্ট্রোল ও ৮৮ নং ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হল তা মোটামুটি এইরুপ। কন্ট্রোল : বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনুমানিক কতজন হতাহত হয়েছে। আমাকে মোটামুটি সংখ্যাটা বললেই হবে। উত্তর এলো তিনশয়ের মতো। কন্ট্রোল : চমৎকার। তিনশই মারা গেছে না কেউ আহত বা বন্দী হয়েছে। উত্তর : আমি একটাই পছন্দ করি। তিনশ মারা গেছে। কন্ট্রোল : ৮৮। আমিও তোমার একমত। ওই কাজটিই সহজ । কিছু জানতে চাইবে না। আবার বলছি চমৎকার। ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই উপরের কথাগুলোর । ওরা যে কোনও ‘বন্দী নেয়নি, সবাইকে হত্যা করেছে সে কথা এর চেয়ে স্পষ্টভাবে জানাতে পারতো না। শুনতে পেয়েছিলাম শহীদ মিনারের কথা: ঐ রাতেই ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। মিনারের নীচের ঘরে ওদের কথায় চারজন ছাত্র লুকিয়ে ছিল, তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। একজন পালিয়ে গেছে। ২৭শে মার্চ সকালে দেখতে গিয়েছিলাম শহীদ মিনার। মাঝখানের মিনারটি সামান্য ক্ষতি হয়েছে। শুনলাম মিনারের নীচের ঘরে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা ছাত্র ছিল না। কিন্তু ছিল তো আমাদের দেশেরই মানুষ। দেখলাম ভাঙ্গা কাঁচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ংস করেছিল পাক বর্বরেরা। ২৫শে মার্চের সেই কালোরাত্রি যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এলো কন্ট্রেলের যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে। সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো বাঙ্গালীদের। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল এই কাজে, কাজ শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল ঐ নরপশুরা। মৃতদেহের হিসাব রেখেছিল ২৬ নং ইউনিট। কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল ২৬ নং ইউনিটকে, রাজারবাগে পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল গোনা শেষ হয়নি। কিন্তু সংখ্যায় অনেক। ক্যাম্পাসের মৃতদেহ কিন্তু ঐ সময়ে সরানো হয়নি। ২৬শে মার্চ সারাদিন রেখে দেয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমাণ্ডার গিয়ে দেখবেন ছাত্রনেতা কেউ আছেন কিনা। সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তাই হয়েছিল। ২৭শে মার্চ সকালে দেখছিলাম ইকবাল হলের পেছনের পুকুর পাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখানোর জন্য ওভাবে রাখা হয়েছিল কিছু মৃতদেহ যাতে বাঙ্গালীরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলাম জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে তৈরী গর্ত করে দেয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু’একজন বিদেশী বাংবাদিককে আসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন একদিন রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্টও তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা। জিঞ্জিরায় যে হত্যাকাণ্ড চালায় পাক সেনারা কদিন পরে তার পুর্বাভাসও পেয়েছিলাম ঔ রাতে। কন্ট্রোল বলেছিল ৮৮ নং ইউনিটকে যে ওখানে অস্ত্র জমা করা হয়েছে, তাই ঐ জায়গায় সেনাদের যেতে হবে আস্তে আস্তে। রাত ফুরিয়ে এলো দিনের আলো জেগে উঠলো। সারারাত ধরে যা দেখেছি যা শুনেছি কোন কিছুই যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছিলো না। মন চাইছিলো না স্বীকার করতে যে এত বড় বিপদ নেমে এসেছে। মনে হয়েছিল, কবে এই অমাবশ্যা কাটবে কবে আবার সম্মানের সাথে মানুষের মত বাঁচার সুযোগ পাব? সেদিন একদিন আসবেই, কিন্তু ২৫ শের সেই রাতে একথাও মনে জেগেছিলো, যখন সেদিন আসবে আমিও যেন থাকি তখন।