পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৫৭

নেই। বরঞ্চ বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে কিছু খাবার ব্যবস্থা কর। টেবিলে খাবার লাগানোও হলো, কিন্তু খাওয়া তাঁর হলো না। মনে হলো বাসার চারিদিকে অনেকগুলো গাড়ী দাড়িয়ে গেল।

 বুটের দুপদাপ আওয়াজ শোনা গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে চকিতে দেখলাম একজন উপরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ভয়ে হিম হয়ে বললাম, ‘তুমি পালাও’। উনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন। জালিমরা হুড়মুড়িয়ে উপরে উঠে এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো। পিশাচরা আমাদের সামন এসে বললো‘কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম কাঁহা, উসকা বিবি কাঁহা। আচ্ছা করকে উনকো বাঙ্গাল নাদেগা। দেখে মনে হচ্ছিল সামনে পেলে যেন ছিঁড়ে খাবে।

 আমার ভাগ্নী বুদ্ধি করে বললো’ ওরা নীচে থাকেন। কিন্তু ওরা কোন কথা শুনলো না। কজন আমার ভাগ্নী জামাইকে নীচে নিয়ে গেল। জালিমরা তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরতে লাগলো সমস্ত ঘর। খুঁজতে নীচে চলে গেলো, আশ্বস্ত হবার আগেই ফিরে এলো আবার। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। আবারও চলে গেল ফায়ার করতে করতে নীচের দিকে। কিছুক্ষণ পর ফায়ারিং থেমে গেল। শোকরগোজারী করলাম আল্লার কাছে। না পেয়ে হয়তো ওরা চলে গেল। বাইরে পর্দ সরিয়ে দেখতে গেলাম।

 কিন্তু উ: একি দেখলাম! খোদা, এর আগে যদি চোখ অন্ধও হয়ে যেতো! দু'পা দু’হাত ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে গাড়ীতে তুলছে ওকে। মাথাটা ঝুলে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ডান পাশটা। আছড়ে পড়লাম মাটিতে। চীৎকার করে উঠতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই ভাগ্নী মুখ চেপে ধরল, “খালাম্মা চীৎকার করবেন না। ওরা আবার এসে যদি বাচ্চাদের মেরে ফেলে। আপনাকে যদি ধরে নিয়ে যায় টের পেয়ে।

 চমকে থমকে গেলাম। পোড়া চোখ জ্বলে ছাই হলো। বুকের ভেতরটা এক শূন্য বেদনায় হাহাকার করে উঠলো। জ্বলে গেলাম-হায়, একটি মানুষ বিহিন সর্বহারা হলাম আজ। পরে জানতে পারলাম, উনি বাথরুমের দরজার এক পাশে উপায়হীন হয়ে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারে ওরা আবার ওর নাম ধরে জিজ্ঞাসা করে বললো, ‘তোমহাৱা নাম কিয়া’? উনি নির্ভিক চিত্তে বললেন, কম্যাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।

 আবার ওরা বললো- ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে উনি তাঁর শেষ বাণী উচ্চারণ করলেন ‘একদফা জিন্দবাদ’। সাথে সাথে গুলি করলো পিশাচ জালিমরা, উনি পড়ে গেলেন। জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মত আবার এক আঙ্গুল উঁচুতে তুলে ধরলেন। পরপর গুলি হলো, দ’টো তাঁর মাথায় বিধল। আর দু'টো ফসকে গেল। মনে হলো, বুকের রক্ত দিয়ে উনি ধুয়ে দিয়ে গেলেন পরাধীন বাংলার যত কলংক আর মলিনতা-আর রক্তকণিকাগুলো।

 কিন্তু মাঝে মাঝে ক্ষীণ আশা জন্মায়, তাঁকে তো মৃত দেখিনি-শুধু গুলি লাগা অবস্থায় তুলে নিয়ে যেতেই দেখেছি। তবে কি তিনি বেঁচে থাকতে পারেন না? নীচে দেখলাম রক্তের বন্যা মাটিতে, শুধু ভোরের আকাশ বাতাস, হাহাকার করি উঠলো নেই-নেই-নেই। কোথা দিয়ে সারা বেলা কেটে গেল, রাত এলো শূন্যতার হাহাকার নিয়ে, তারও শেষ হলো। সকাল হলো, কারফিউ ভাঙ্গল কিছুক্ষণের জন্যে। কত মানুষ ছুটে এলো চেনা-অচেনা। চেয়ে দেখলাম কত মানুষ অশ্রুসজল নেত্রে রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিল।

 বোবা কান্নায় অসহায় হয়ে ছোট তিনটি শিশু বুকে নিয়ে দুলাভাই ডা: কাজী আব্দুল খালেকের বাসায় ছুটে গেলাম। তাঁরা ঘৃণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। আবার হাহাকার আর্তনাদ উঠল। কিন্তু কান্নার সময় কোথায়, সান্তনার অবকাশ নেই। পালাতে হবে, যদি আবার জালিমেরা আসে। তাই পাড়ি দিলাম অদৃষ্টের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে। জিঞ্জিরা গেলাম। নৌকা পার হবার সময় গোলাগুলি আরম্ভ হলো।