পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড আমি বাধ্য হলাম প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিতে। ক্লাব ম্যানেজার কুদ্দুস আর দারোয়ান খয়ের ছাড়া কেউ তখন ছিল না। খয়ের বাইরের গেটে তালা দিয়ে রেখেছে। কুদ্দুস বাসায় ফেরার জন্য আয়োজন করছিল। মর্নিং নিউজের শহীদুল হককে এবং অবজার্ভারের মুসা ও কে জিকেও কয়েকবার টেলিফোনে চেষ্টা করলাম-লাইন পেলাম না । শেষ পর্যন্ত শহীদুল হককে পেলাম, কিন্তু তখন আর আমাকে প্রেসক্লাব থেকে উদ্ধার করার উপায় ছিল না। সে উৎকণ্ঠার সাথে জবাব দিল, আমাদের সামনে চৌমাথায় আর্মি। গাড়ী বের করা যাবে না। ক্লাবের একটা কক্ষে রাত কাটানো ছাড়া তখন আর উপায় কি! এর পরই সে দুটো সহস্যজনক টেলিফোন কল এলো। প্রেসক্লাব আক্রমণের সাথে এই ফোন কলের কোন যোগসূত্র রয়েছে কিনা প্রতিষ্ঠা করা কষ্টকর। তবে প্রেসক্লাব আক্রমণের যত কারণই থাকুক না কেন, একটা কারণ আমার কাছে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। গিয়েছিল। সিড়ি ও বাইরের গেটেও তালা ছিল । এ রাড়ীতে কেউ থাকে না, এমন একটা ধারণা দেয়ার জন্যেই সর্বদা দ্বারে বাইরে থেকে তালা দেয়া হয় । আমি তখন ক্লাবে একা-নীরব নিস্তব্ধ ক্লাব এলাকা । সমস্ত আলো নেভানো। গরমের মধ্যেও ফ্যান চালাইনি। বের হবার পথ বন্ধ। চারদিকে ভয়াবহ আক্রমণ চলছে। তোপখানা রোডের উপর প্লাটুন দৌড়ে যাচ্ছে । ট্রাকের ঘর ঘর শব্দ। আমি রাইফেল ষ্টেনগান, মেশিনগান আর মর্টার শেলের গগনবিদারী বীভৎস শব্দের রাজ্যে একা একটা সোফায় বসে আছি। রাজারবাগ আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিক থেকে গোলার আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ মর্তমান ফরেন অফিস ও ইউসিসের তেমাথায় একটা আলো জুলে উঠলো-সমগ্র এলাকাটা তঅন দিনের মতো স্পষ্ট। জানালার ফাঁক দিয়ে আর্মির চলাফেরা লক্ষ্য করা সম্ভব । বহুসংখ্যক ট্রাক বোঝাই সৈন্য ক্লাবের সম্মুখ দিয়ে পুরানা পল্টনের দিকে যাচ্ছে। একটু পরেই নাবাবপুর রেল গেটের দিকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আকাশের দিকে কালো ধোঁয়া আর আগুনের শিখা উড়তে থাকে। তারপর এক সময় পুরানো শহরের মধ্যভাগে বংশাল রোডের দিকে আগন দেখা গেল। তখন একথা সত্যই যে, শত্রু বহিনী পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধ্বংসের অভিযানে নেমেছ-গণহত্যক চলছে। কিন্তু তখনো জানতাম না যে পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর সাথে দখলদার সেনাদের যুদ্ধ চলছে। রাজারবাগে বীর পুলিশরা ম্যাগাজীন খুলে প্রতিরোধ লড়াই করছে। পুরনো শহরের গলিগুলোর ব্যারিকেড বিদেশী সেনাদের পথ বন্ধ করে রেখেছে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গুলীবর্ষণ হচ্ছে। এই নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যেও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সব মুক্তিকামী মানুষ হানাদারদের প্রতিরোধ করছিল তাদের একটা সাহসী দল সেকেণ্ড গেটের পাশের সম্মুখে সারারাত ব্যারিকেড সৃষ্টি করে গেছে। প্রেসক্লাবের ডান দিকে সেক্রেটারিয়েটের শেষ দেয়ালের গা ঘেষে যে কাঁচা গলিটা গেছে, তার মুখে সন্ধ্যার সময়ই একটা বড়ো ট্রাক রাখা হয়েছিল এবং তার পাশে কয়েকটা রিক্সা রেখে হানাদারদের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয় । আর সেখানেই একদল দুঃসাহসী যুবক, যারা দোকানদার, রিক্সাচালক গভীর অন্ধকারে প্রতিবার ইয়াহিয়ার বাহিনী তোপখানা রোড দিয়ে যারার সময় এইখানে বাধা পেয়েছে, কনভয় থামিয়ে রাস্তা পরিস্কার করেছে। ক্লাব দোতলার দরজার ফাঁক দিয়ে সারারাত দেখেছি সাঁজোয়া বাহিনী বা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্লাটুন এই পথ ধরে পুরানো শহরের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে এই ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়েছে।