পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՖԳՖ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের পরিচয় প্রতীক। রমনী শীল যে এ ক্যান্টনমেন্টে দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষেীর কার্যে নিয়োজিত ছিল, ও মনসুর আলী যে দীর্ঘ দিন ধরে এখানে জুতা মেরামতের কাজ করতো, উভয়েই এই বাঙ্গালী নিধন পর্বের প্রত্যক্ষদশী। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জাহাঙ্গীর, কয়েকজন মেজর, আর্মি এডুকেশন কোরের ক্যাপ্টেন মকবুলসহ মোট ২৪ জনের লাশ একটা স্তর প্রথম গর্তে পাওয়া গেছে। একটি লাশ মহিলার বলে মনে হয়। সারা দুপুর আমি বিস্তীর্ণ প্রান্তর ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমার সঙ্গে নর সুন্দর রমনী শীল আর জুতা মেরামত কারী মনসুর। তারা আমাকে শহ শত গর্ত দেখালো। কোন কোন গর্ত হতে শেয়াল লাশের কিছুটা টেনে বের করেছে। অনেক গর্ত থেকে ভেসে আসছে পুতি গন্ধ। এখানে সেখানে এলোমেলো পড়ে রয়েছে জামা কাপড়, গেঞ্জির টুকরো। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি মাঠ। সেখানে হেলিকপ্টার উঠানামা করে। তার দক্ষিণে আরো একটি মাঠ। সেটা কিছুটা নীচু সমস্তটা জায়গা জুড়ে রয়েছে গর্তের পর গর্ত। প্রতিটি গর্তেই অসংখ্য কংকাল। আর মাঠটায় ছড়িয়ে রয়েছে শত শত অসহায় বাঙ্গালীর হাড় আর মাথার খুলি। কোথাও পড়ে রয়েছে খসে পড়া মাথার চুল। পূর্বদিকে বিরাট বিরাট তিনটি ডোবা দেখালো আমাকে রমনী শীল। দেখলেই বোঝা যায় সেখানে মাটি কেটে আবার চাপা দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের লাশ এখানে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে বলে তারা আমাকে জানালো। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তরফ হতে এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সবগুলো খুঁড়তে সময় লাগবে। নরসুন্দর রমনী শীল ৩৫/৪০ বছর বয়সের ছোটখাটো মানুষটা আর মনসুর আলী লম্বা হাল্কা গড়নের প্রৌঢ়। উভয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এ সামরিক ছাউনীতে কাজ করতো । গত ২৭শে মার্চ বিকেল ৫টার দিকে কোয়ার্টার মাষ্টার মিটিং আছে বলে উভয়কে ব্রিগেড অফিসে ডেকে নিয়ে যায়। সেদিন থেকে উনত্রিশ তারিখ পর্যন্ত তাদের ঐ অফিসে আটকে রাখা হয়। তাদের সঙ্গ আরো ৫০ জন লোক ছিল ঐ কক্ষে বন্দী। ২৯শে মার্চ বিকেল অনুমান চারটার দিকে তারা দেখতে পায় ব্রিগেড অফিসের পাশের কুল গাছটার নেচে তাদের প্রিয় বাঙ্গালী উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের গুলি করে নর্মিমভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। প্রথমে একজন একজন করে ও পরে তাড়াতাড়ি নিধনযজ্ঞ শেষ করার জন্যে ৩/৪ জনকে এক সাথে কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা ও দড়ি দিয়ে শক্ত করে হাত বাঁধা অবস্থায় ঐ কুল গাছের নিচে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন ভোর বেলা তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। ওরা সবাইকে জানিয়েছে যে তাদের চোখের সামনেই অন্তত: তিনশতেরও বেশী লোককে খুন করা হয়েছে। রমনী শীল ও মনসুরের সাথে যারা বন্দী ছিল তাদের মধ্যে অতি আবশ্যক কাজ সমাধানের জন্য দু’চারজনকে রেখে বাকী সবাইকে ৩০শে মার্চে খুন করা হয়। তাদের দুজনকে খুন করা হয়নি কিন্তু হুকুম ছিলো সামরিক ছাউনি এলাকার বাইরে তারা যেতে পারবে না। সে হুকুমেই তারা সেদিন মেনে নিয়েছিল প্রাণে বাঁচার জন্য। তাদের চোখেমুছে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর ভয়াল ছাপ আজো বিদ্যমান। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে দেখা যায় বিশ্বের এ জঘন্যতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ব্রিগেডিয়ার শফির নেতৃত্বে। হত্যাযজ্ঞে তার সহযোগীরা ছিল কর্ণেল খিজির ইকবাল, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল বার্কি, সিকিউরিটি বিভাগের মেজর সেলিম, মেজর মোস্তফা, মেজর সিদ্দিকী ও ক্যাপ্টেন কবির। এই নরপশুদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৈশাচিকতায় সহযোগিতা করে কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের প্রিন্সিপাল অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম, কে আমীন ও কুমিল্লা ষ্ট্যাণ্ডার্ড ব্যাঙ্কের অবাঙ্গালী ম্যানেজার আলীম।