পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

여 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড শ্ৰী পূর্ণচন্দ্র বসাক, বি, এ, পিতা মৃত শ্রী বীর চন্দ্র বসাক ১৮, তাঁতী বাজার লেন, ঢাকা-১ আমি ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে আমার ১৮, তাঁতীবাজারস্থিত বাসায় ছিলাম। রাত বারটায় উত্তর দিক থেকে অকস্মাৎ কামানের আকাশফাটা গর্জন শুনে আমি তেতলার ছাদের উপর দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসসমূহে আগুনের ফুলকি ও লক্ষ লক্ষ গুলির আগুনের ফুলকি আকাশ ভরে গেছে। অনবরত কামানের ভয়াল ও ভয়ঙ্কর আওয়াজ আসছে। উত্তর দিকে আকাশে দেখলাম, একটা ঘোলাটে বেলুনের মত আগুনের বিরাট পিণ্ড পশ্চিম দিক থেকে আস্তে আস্তে উঠে পূর্বদিক দিয়ে গভর্নর হাউসের কাছে এসে নেমে পড়লো। এই সময় দেখলাম-চারিদিকে জনপদ, বস্তি এলাকায় আগুন আর আগুন জুলছে, বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ হচ্ছে কামানের কানফাটা গর্জন ভেসে আসছে। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম- গুলির আওয়াজ ক্রমে ক্রমে গুলিস্তান থেকে নওয়াবপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই সদরঘাট খৃষ্টানদের গীর্জার সম্মুখে সামরিক গাড়ী ও ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর আওয়াজ শুনলাম। এসময় শতকণ্ঠের “মাগো, বাবাগো, বাঁচাও বাঁচাও,” আর্তনাদ শুনলাম। শাঁখারী বাজারের সকল হিন্দু জনতা যার যার ছাদে দাঁড়িয়ে এ বীভৎস কাণ্ড দেখছিল। কিছুক্ষণ পর সদরঘাট টার্মিনালে ভীষণ গুলিবর্ষনের শব্দ শুনলাম। রাত দুটার সময় মাইকে ঘোষণা করা হলো- রাজধানী ঢাকায় ২৬শে মার্চ ভোর পর্যন্ত কার্য জারী করা হয়েছে, যার যার বাড়ীতে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীন বাংলার পতাকা আছে তা অবিলম্বে নামিয়ে ফেলে সে স্থানে পাকিস্তানের পতাকা তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। রাত দুটার পর রাজধানীর পূর্বদিক থেকে আর একটি জুলন্ত বেলুনের মত ঝলমলে গ্লোব পূর্ব আকাশ থেকে উঠে আস্তে আস্তে সোজা পশ্চিমে ভেসে গিয়ে মিশে যেতে দেখলাম। ইহার পর আর একটি গুলির আওয়াজও কানে আসে নাই। চারিদিকে নীরব, নিস্তব্ধ, শ্মশানের হাহাকার, আগুন আর আগুন জুলছে, জুলছে দেখলাম রাজধানী ঢাকার চারিদিকে জনপদ ও বস্তি এলাকা জুলছে। ২৭শে মার্চ সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়ার পর শুনলাম শাঁখারী বাজারের কোর্টের প্রবেশ পথের একটি বাড়ীতে দশজন হিন্দুকে এই ঘরে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং ডঃ শৈলেন সেনকে গ্রেফতার করে জগন্নাথ কলেজের পাক সেনাদের ছাউনিতে আটক করা হয়েছে। ইংলিশ রোড দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেখলাম ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোডের দুই পাশের কোটি কোটি টাকার কাঠের কারখান ও মেশিনপত্র ভস্ম হয়ে পাক সেনাদের বীভৎসতার স্বাক্ষর হয়ে পড়ে আছে- দুই পার্শ্বের বাণিজ্য এলাকার সকল দোকান ও বাণিজ্য কেন্দ্র নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। রাস্তাঘাট শূন্য, কোথাও কোন মানুষ নেই আমি কাজী আলাউদ্দিন রোড হয়ে বাবুপুরা ফাঁড়িতে দেখলাম আটজন পুলিশী পোষাক পরা লাশ গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে ফাঁড়ির বারান্দায় ও রাস্তায় বিকৃতভাবে পড়ে আচে। রেল লাইনের দুই পাশের বস্তি এলাকা ভস্ম ছাই হয়ে পড়ে আচে, দেখলাম চারদিক জনমানবশূন্য। আমি দ্রুত আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জি, কে, নাথ, সংস্কৃতের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, সংস্কৃতের অধ্যাপক শ্রী পরেশ চন্দ্র মণ্ডলের খোঁজে জগন্নাথ হলে গুলির আঘাতে ঝাঁঝড়া হয়ে আছে। হলের কাঁচের জানালাসমূহ ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে আছে। হলের পুকুর পাড় দিয়ে আমি অগ্রসর হওয়ার সময় দেখলাম হঠাৎ পুকুরের মধ্য হতে একজন মানুষের মাথা উপরের দিকে উঠার চেষ্টা করছে, ভীতসন্ত্রস্ত, দিশাহারা উন্মাদের মত হয়ে পানি থেকে মাথা তুলে ক্ৰন্দন ও বুকে চপেটাঘাত করতে করতে বলতে লাগলেন, “দাদা ওদিকে যাবেন না, ওরা আমাদের সব মেরে ফেলেছে।” আমি