পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>br বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড নাই। আমি আরও অগ্রসর হয়ে হলের কেন্টিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি প্রাণিও নাই- নীরব, নিস্তব্ধ, জনমানবশূন্য। কেন্টিনের মধ্য দিয়ে হলের নর্থ হাউসে প্রবেশ করে সিড়ির নিকটে দেখলাম- একজন হিন্দু যুবকের লাশ পড়ে আছে- মাথার চুল আগুনে পোড়া, সারা দেহ গুলিতে ঝাঁঝড়া, আমি দোতলায় না উঠে সোজা রাস্তায় নেমে পড়ে হলের শহীদ মিনারের সামনে এসে দেখলাম- শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে আছে। শহীদ মিনারের পিছনেই সদ্য মাটি তোলা একশত ফুট লম্বা এক বিরাট গর্ত দেখলাম- গর্তটি কিছুক্ষণ পূর্বেই মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে। গর্তের উপর মাটি ভেদ করে কারো কারো হাতের পাঞ্জা, পায়ের আঙ্গুল দেখা যাচ্ছে। আমি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে হলের শেষ মাথায় লোহার গেটে পৌছলে পিছন থেকে একটি দিশাহারা কর্কশ নারীকণ্ঠ চিৎকার করে বললেন, “আপ কাহাপর যাতে?” আমি সেই কষ্ঠের দিকে নজর না দিয়ে শামসুন্নাহার হলের দিকে অগ্রসর হয়ে জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর মিঃ জি, কে, নাথ রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, এবং পরেশ মণ্ডলের কোয়ার্টারের প্রবেশপথে গিয়ে দেখলাম- কোয়ার্টারের দরজা জানালা সব খোলা, জনমানবশূন্য, সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখলাম- দোতালা থেকে পচা দুৰ্গন্ধ ভেসে আসছে, সিড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রক্তের চিহ্ন জমাট হয়ে আছে। আমি এ পচা-দুর্গন্ধ ও জমাট রক্ত দেখে আর উপরে উঠতে পারি নাই। বন্ধুদের খোঁজ করতে গিয়ে এখানেই আমি প্রথম ভয় পেলাম এবং ভড়কে গেলাম। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে। আমার উপর উঠতে সাহস হল না আমি নিচে নেমে আসলাম এবং ভীত সন্ত্রস্তভাবে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথ দিয়ে দ্রুত ফিরে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথে জগন্নাথ হলের একজন চাপরাশীর সাক্ষাৎ পেলাম। সে বললো আমাদের হলের প্রভোষ্ট ডঃ জোতির্ময় গুহঠাকুরতা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের দোতলায় ৯নং কক্ষে আছেন, তিনি জীবিত আছেন। আপনি তার সাথে সাক্ষাৎ করুন। আমি হাসপাতালের দোতলার ৯নং কামরায় প্রবেশ করতেই হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা আহত হলের একজন যুবক ছাত্র আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ৰন্দন করতে করতে বলতে থাকলেন দাদা আমি কি বেঁচে আছি? দেখেন আমাকে ওরা গুলি করেছে। ঐ যে দেখুন জোতির্ময় বাবু- তাকেও পশুরা গুলি করেছে। আমি তাকে উন্মাদের মত মনে করলাম, তার অসংলগ্ন কথাবর্তায় বুঝতে পারলাম সে প্রকৃতিস্থ নয়। আমি আরও অগ্রসর হয়ে দেখলাম জোতির্ময় বাবু শুয়ে আছেন জ্ঞানহারা, মাঝে মাঝে দীর্ঘ চাপা নিশ্বাস ফেলছেন এবং মাঝে মাঝে তিনি চক্ষু খুলে বন্ধ করে ফেলছেন। আমি অনেকক্ষণ তার শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে তার করুণ অবস্থা দেখলাম। তিনি একবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কে? আমি বললাম “আমি বসাক, আমি পূর্ণ বাবু”। তিনি উত্তরে বললেন “ও”। একটুপরেই বিড় বিড় করে বললে, “ডঃ গবিন্দবাবু, ডঃ গোবিন্দ বাবু ইজ প্রসিডিং ওয়েল।” একথা বলেই তিনি জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন, সংগা হারিয়ে ফেললেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার এই অন্তিম দৃশ্য দেখছিলাম। একটু পরেই বারান্দা হতে তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী ক্ৰন্দনরতা অবস্থায় কাতরকষ্ঠে বললেন, “দাদা, আপনি এসেছেন, আমাকে একটু সাহায্য করুন। কাল থেকে এ হাসপাতলে কিছুই নাই, আমাকে একটি এক্সরে প্লেট যোগাড় করে দিন৷” আমি উত্তরে বললাম “দাস কোম্পানীর দোকান খোলা পেলে এখনি এনে দিচ্ছি’- বলে তাকে প্রবোধ দিলাম। আমি তাকে ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সমস্ত ঘটনা বললেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম গুলি কোথায় কোথায় লেগেছে? উত্তরে বললে, ঘাড়ে একটি গুলবিদ্ধ হয়ে ঘাড় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। পেটে নাভির কাছে ব্যথার যন্ত্রণার কথা বলেছেন। বোধয় পেটের ভিতরও গুলি লেগেছে। আমি তাকে সন্তুনা দিয়ে চলে আসলাম। প্রবেশ পথে আসলে হলের সেই আহত গুলিবিদ্ধ ছাত্রটিকে জিজ্ঞাসা করলাম “তুমি কি করে বাঁচলে?” সে বলতে লাগলো, খান সেনারা ব্যাপক তল্লাশী চালায়- হল বন্ধ থাকলেও কতিপয় অনার্স পরীক্ষার্থী ও এম, এ, পরীক্ষাতী প্রতিভাবান বিশপচিশ জন ছাত্র হলে অবস্থান করছিল। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশ করে যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করেছে, আমি সে সময় হলের বাথরুমে পালিয়েছিলাম। তারা আমাকে বাথরুমেই ধরে ফেলে, আমাকে ওরা ধরে বললো, “তোমকো কুচ নেহি বলেগা,” এবং দোতারা থেকে আরও তিনজন ছাত্রকে নামিয়ে নিয়ে এসে আবার বললো, “ইয়ে দেখ তোমলোগ কো কুচ