পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br○ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রদের ওপর মারাত্মক আঘাত হানে। কয়েক দিনের ভেতরই সিলেট জেলায় তিন শত মাইল সীমান্ত এলাকা থেকে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা অথবা বিতাড়িত করে মার্চের মধ্যেই সমস্ত হবিগঞ্জ মহকুমা, মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। ৩রা এপ্রিল মুক্তিপাগল বাঙ্গালী বীরেরা সিলেট শহর দখল করে নেয়। হানাদার বাহিনী শালুটিকর বিমানবন্দর ও সংলগ্ন জংগলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপরই শুরু হয় বৃষ্টির মত পাক বাহিনীর বিমান হানা। সারা শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলীর ঝড়। শত শত আদম সন্তান রক্তাক্ত আহত হয়ে হাসপাতালের দারস্থ হয়। মানব সেবার প্রতীক প্রখ্যাত শল্যবিদ অধ্যাপক শামসুদ্দিন শাণিত ছুরি হাতে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজে রত রয়েছেন। হাসপাতালে আলো নেই, পানি নেই, পথ্য নেই। তাতে কি, শামসুদ্দিন সাহেব আছেন। এক হাতে অস্ত্র চালনা, অন্য হাতে অন্যান্য সব কাজ। ৮ই মার্চ থেকে আবার শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। পাক দস্যরা স্থল ও বিমানবাহিনী নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমস্ত শহর তখন জনশূন্য। প্রাণপণ বাঁচাবার আদিম উগ্রতায় শহরবাসী চলেছে গ্রামের আশ্রয়ে- দুর্গত শহরের সাক্ষী ডাঃ শামসুদ্দিন আর তার রোগী। ছাত্রদের প্রতি ডাঃ শামসুদ্দিন- “আমরা প্রবীণ। আহত বাঙ্গালীদের সেবায় আমাদের থাকতে দাও। তোমরা নবীন যুবক, নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ কর। এখান থেকে বর্বর পশুদের শিকার হয়ে কোন লাভ নেই।” ডাক্তারদের প্রতি- “কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না।” সেই রক্তস্নাত ৯ই এপ্রিল। ইতিহাস থমকে গেছে। আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ভঙ্গ করে জেনেভা কনভেনশনের নিয়ম অমান্য করে মারণাস্ত্রসহ কতকগুলো পাক নরঘাতক সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতল ঘেরাও করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। শল্য প্রকোষ্ঠ। বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গৌরবর্ণ সুদর্শন অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ অবিশ্রান্ত কর্মরত। ঝড়ের বেগে প্রকোষ্ঠে ঢুকে সংগীন উচিয়ে ক’টি পশু সেনা ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। হাসপাতালের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অশ্রুসিক্ত সবুজ ঘাসের শীষে দাঁড় করালো তাকে। তারপর না, আমি সম্বিত হারিয়ে ফেলছি। কি লিখবো, কেমন করে লিখবো। লিখে কি হবে? লাভ কি? পৃথিবীর মানুষ কি বিশ্বাস করবে আমাকে? অবিশ্বাস্য ঘটনা কি বিশ্বাস করা যায়। না, অন্যের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে আমি লিখবো নাকি? আমি আমাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না। ভগবান যীশুও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। হ্যাঁ, হাসপাতালের চিরাচরিত মানবিকতা পবিত্রতাকে বিদীর্ণ করে গুলী করা হলো। গুলী করা হলো ঋষি শামসুদ্দিনকে, মানুষ শামসুদ্দিন আহমদকে। উনসত্তরের গণআন্দোলনে ডাঃ শামসুদিন বলেছিলেন- “হে সভ্য জগত, গণআন্দোলনকে দমন করতে গুলী করো না। তার বদলে ব্যবহার করো রাবারের বল বা বেগে চালিত পানি।” এক-দুই করে তিনটি গুলী করা হলো তাঁকে। মৃত্যুহীন প্রাণ ক্ষণিকের ভিতর শেষ হয়ে গেল। প্রাণপ্রিয় দরদী শিক্ষককে অনুসরণ করল তরুণ অস্ত্রোপচারক ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা, সহকারী সেবক মাহমাদুর রহমান, এ্যাম্বুলেন্স চালক কোরবান উল্লাহ। ক্লান্ত হলো নরপশুদের সামরিক ক্ষুধা। ডাঃ শামসুদিন ছিলেন মানবসেবার ইতিহাসে এক বিরল আদর্শ। কি সম্মোহনী শক্তি তাঁর ছিল জানি না। ছাত্রবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নম্রভাষী। তাঁর কাজই কথা বলত। বিভাগ-পূর্ব ভারতে তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম ষ্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি। কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ছাত্রনেতাদের অন্যতম।