পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

있어 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড লাশ নেই, সামনেই দেখলাম সেই দু’জন শহীদ সিপাহীর রক্ত মাখা পোশাক এক জায়গায় গুটিয়ে রাখা দেওয়া হয় নাই দু’দিন। আমাদের কেউ কেউ ক্ষুধায় একেবারে কাতর হয়ে খেতে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানালে ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলতো, “তোমহারা মুজিবর বাবা খানা ডেজেগো।” ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ সকাল থেকেই ওরা তিন চার জন করে কামরা থেকে নিয়ে পাশের কামরায় বেদম পিটুনি আরম্ভ করলো। এভাবে আমাদের সকল বন্দীদের উপর অসহ্য মার পিট চললো। আমি সেই কামরায় প্রবেশ করার পর পরই দেখলাম দশ বার জন জল্লাদ পশু ওদের হাতের ছোট ছোট লাঠি। বন্দুকের বাট, বুট, যার হাতে যা ছিল তাই দিয়ে নির্মম ভাবে পিটাতে থাকে। আমি ওদের মারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর আমাকে পাশের কামরায় নিয়ে পুলিশের কোথায় কি আছে, কত পুলিশ অফিসার থানায় আছে, পুলিশ কি মিটিং করেছিল ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু অসহ্য পিটুনি সহ্য করার পরও আমি কোন ব্যাপারেই সঠিক তথ্য ওদেরকে সরবরাহ করি নাই। ১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ আমরা সকল বন্দীরা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। ফেটে পড়ে বলতে থাকে, “শালা লোগ চাউল খায়েগা, চাউল।” সে ভাত আমাদেরকে খাওয়াবার জন্য আনা হতো না, বরং আমাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করার জন্যই আমাদের জানালার সামনে ধরে রাখা হতো। ওরা জানালার সামনে সামান্য কিছু ভাত ধরে ঠাট্টা তামাশা করতে থাকলেও আমাদের কোন ক্ষুধার্ত বন্দীই ওদের বিদ্রুপের সামনে কোন কথাই বলে নাই। ওরা ভাত নিয়ে এমন উলঙ্গভাবে আমাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করে চলে যাওয়ার পর বন্দীখানায় কান্নার রোল পড়ে যায়। আমরা সবাই কাঁদতে থাকি হাউমাউ করে। ওরা সেই কাঁদতে কাঁদতে পার করে । পশুরা মেশিনগান নিয়ে সব সময় আমাদেরকে পাহাড়া দিচ্ছিল। পরের দিন ২৮শে মার্চ আমরা জানালা দিয়ে দেখতে পাই পশুরা থানার অস্ত্রাগার ও মালখানার সকল অস্ত্র ও মালামাল সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওদের মটর ট্রাকে করে। হাজতে রাখা আমাদের পূর্ববর্তী আহত বন্দীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় আমরা জানতে পারি নাই। ২৯শে মার্চ পর্যন্ত আমাদেরকে সারাদিন বন্দীখানায় এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। একফোটা পানিও দেওয়া হয় নাই কোন বন্দীকে, কোন খাদ্যও দেওয়া হয় নাই। ২৯শে মার্চ বিকাল ৪টায় তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ইমাদ আহমেদ চৌধুরী রমনা থানায় আসেন এবং আমাদেরকে তার সম্মুখে হাজির করা হয়। এমন সময় আমাদের এক বৃদ্ধ সিপাহী ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় একেবারে জ্ঞান হারা হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ইমাদ আহমেদ চৌধুরী তখন অশ্রুভরা চোখে বন্দীদের দেখছিলেন। আমার সামনে এসে আমার ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে তিনি আমাকে ধরে হাউ মাউ করে কেদে ফেললেন। পশুদের বুটের লাথি, বেয়নেটের আঘাত ও লাঠি এবং বেতের এলোপাতাড়ি আঘাতে আমার সমস্ত চড়ে মিল ব্যারাকে চলে যান।” আমি থানার বাসায় গিয়ে দেখলাম, সব লুট হয়ে গেছে, পাক পশুরা সব নিয়ে গেছে। খাওয়ার কিছুই ছিল না, না খেয়ে আহত ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত দেহ নিয়ে খোদাকে আমার অত্যাচারের সাক্ষী রেখে শূন্য খাটে এলিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে আমি রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতলের দিকে রওয়ানা হই অনেক কষ্টে। পথে দেখলাম তখনও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশের ব্যারাক দাউ দাউ করে জুলছে, জুলছে পুলিশের পোশাক-পরিচ্ছদ আসবাবপত্র। ব্যারাকের পিছনেই পাকা জায়গায় দেখলাম চাপ চাপ রক্ত শুকিয়ে আছে। ব্যারাকের মাঝখানে দেখতে পেলাম পায়ে বুট দেওয়া দুটি পুলিশের লাশ তখনও জুলছে। পশুদের ভয়ে আর সামনে এগোতে সাহস পেলাম না। অন্য রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি হাসপাতলে দিকে পা’ বাড়ালাম। স্বাক্ষর/ ૨૨-૭-So૧8