পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©ᎼᏬ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড বাংলাদেশকে যেদিন স্বীকৃতি দেবে সেই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে। দিন তারিখের কলকাতার ঐতিহাসিক জনসভা শোনার জন্য তাই আমাদের প্রতীক্ষা ছিল একটা ভিন্নতর। ইন্দিরাজীর ভাষণ শেষ হলো। খুবই বিস্ময় লেগেছিল। কেন জানি ট্রানজিষ্টারের সামনে থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। রাত বাড়ল আকাশ বাণীর সংবাদ শেষ হলো। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো শীঘ্রই বিশেষ ঘোষণা প্রচার করা হবে। সমস্ত দিনের ক্লান্ত দেহমন। পরিবারের সকলেই ঘিরে বসলাম ট্রানজিষ্টারের চারিদিক। কিন্তু কোথায় সে ঘোষণা সময় কেটে যাচ্ছিল। একে একে বাচ্চারা ঘুমুতে চলে গেল। মাথার কাছে ট্রানজিষ্টারটা খোলা রেখে প্রতীক্ষা করতে করতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গলো বিমানবিধ্বংসী কামানের কটকট শব্দে। বুঝলাম যুদ্ধ বেঁধে গেছে। ৬ই ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দিল স্বাধীন বাংলাদেশকে। সে এক অনন্য অনুভূতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির সংবাদ এলোমেলো করে দিচ্ছিল আমার দেহ মনকে। বাচ্চারা কাঁদছিল ওদের আব্বার জন্য। আমি চেষ্টা করছিলাম ওদেরকে সান্তনা দিতে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বীকৃতি আর অতি প্রিয়জনের মৃত্যুর আশঙ্কা আমার আত্মাকে যেনো অসার করে তুলেছিল। ডিসেম্বরের দিন গুলো প্রতিদিন যেনো নতুন নতুন বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াতো। ১৭ তারিখ সকালে যখন পাক আর্মিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল তখন শেখ মুজিবের বাসা থেকে শুধু মাত্র সিভিল আর্মড অফিসার দুজনকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রধানতঃ আর্মিকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য সিভিল আর্মড অফিসার নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সিভিল আর্মড অফিসার দু’জনকে ফিরিয়ে নেয়ার সাথে সাথে আর্মি প্রহরীরা উচ্ছঙ্খল হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিকে ওরা আশা করেছিল যে, ওদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত যখন চারিদিক থেকে “জয় বাংলা” ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল তখন ভীষণ রকম ক্ষেপে গেল ওরা। আমাদের ঘরের মধ্যে কাপড় শুকোবার জন্য তার বাঁধা ছিল। রাতে তারটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। রক্তের মত লাল দু’টো চোখ। প্রহরী দলের অধিনায়ক সুবেদার রিয়াজ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। কঠোর ভাবে সে বললো খোকাকে ডাকো ঠাণ্ডা হয়ে বললাম খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কোন কথা থাকলে আমাকে বলতে পার। আমার মুখের দিকে কঠোর ভাবে তাকিয়ে সে বলল সাবধানে থাকো। মেজর তারা সিং এলেন বেলা ন’টার সময়। তারা সিং সাধারণ বেশে এসেছিলেন কিন্তু পেছনে তিনি একদল সৈন্যকে পজিশন নেয়া অবস্থাতে রেখে দিয়েছিলেন চারিদিকে। খালি হাতে শুধু ওয়ারলেস সেট সাথে নিয়ে তিনি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে বুঝাচ্ছিলেন। প্রথমে ওরা সারেনডার করতে চায়নি। শেষে দুঘন্টা সময় চেয়েছিল। গেটের সামনে থেকে ওদের কথা শুনে মেজর তারা সিং যেই পা বাড়ালেন অমনি ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলো বাচ্চারা আপনি যাবেন না মেজর। যাবেন না। সময় পেলেই ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। সত্যিই সময় পেলে ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলতো। কিন্তু মেজর তারা সিং তাদের আর সে সময় দেননি। ঢুকে পড়েছিলেন গেটের মধ্যে। পাশের বাঙ্কার থেকে কাঁপতে কাঁপতে হানাদাররা তখন বের হয়ে আসছে আত্মসমর্পণের জন্য। দৈনিক বাংলা ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২