পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (একাদশ খণ্ড).pdf/৭৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



705

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ড

 ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা পাঁচশ'গজ পিছনে সরে এলাম ঠিক চৌমাথার ওখানে। সেখান থেকেই থ্রি ইঞ্চি মর্টার থেকে শেলিং শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব। সমস্ত দিনটা সেখানেই কেটে গেল।

 সবচেয়ে আশ্চর্যের যে, দু'পক্ষে সমানে গোলাগুলি চলছে আর তার মধ্যেও গ্রামের জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করে চলেছে। কেউ গোলাবারুদ মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ মুক্তিবাহিনীর খাবার তৈরী করছে, আবার কেউ ডিফেন্স থেকে সংবাদ এনে দিচ্ছে। প্রতিটি জনগনের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে।

 হঠাৎ দেখলাম জনৈক মুক্তিযোদ্ধা কালিগঞ্জের দিক থেকে ছুটে আসছেন। কাছে আসতে জানতে পারলাম, কালিগঞ্জে ৪ জন পাক সেনা খতম হয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা ধন্যবাদ জানালেন এই সময় সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে।

 এক বৃদ্ধ এলেন কয়েকটি ডাব নিয়ে। এই বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে ডিফেন্সে যুদ্ধ করছে। ছেলেকে না পেয়ে ডাবগুলো সব আমাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। ছেলের জন্য একটা রাখতে বলায় তিনি বললেন, আপনারাও তো আমার ছেলে। বৃদ্ধের দৃঢ় এই মনোবল সবাইকে মুদ্ধ করল।

 একজন তরুন মুক্তিসেনা আহত হয়েছে তাড়াতাড়ি পৌছে দিতে হবে তাকে হাসপাতালে। ভার পড়ল আমাদের তিনজনের উপর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহত সৈনিককে নিয়ে ফিরে চললাম দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর পরিত্যাগ করে-

 হে দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর তোমায় অভিনন্দন- অভিনন্দন বাংলার শক্তিকে, যারা শ্যামনগর মুক্ত রাখার জন্য জীবনপণ যুদ্ধ করে চলেছে- বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্যকে-

 কয়েকদিন পর জনৈক মুক্তিযোদ্ধা দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে এলেন, শ্যামনগর কালিগঞ্জ হানাদাররা দখল করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সোনার বাংলা কি তবে দখলদারদের থেকে মুক্ত হবে না? ভাবনার অবসান করলেন মুক্তিযোদ্ধাই, ভাবছেন কেন, এ ত সাময়িক পরাজয়, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হব। তাছাড়া গেরিলা যুদ্ধের নিয়মই তো এমনি’।

 এরপর শ্যামনগর, কালিগঞ্জ থেকে কি কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সরে এলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলাম- উত্তরে বললেন, “আমাদের সবচেয়ে অস্ত্রের অভার, যার জন্য এই সাময়িক পরাজয়। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে রাইফেল, এলএমজি ও দু’একটা থ্রি-ইঞ্চ মর্টার আর ওরা আধুনিক অস্ত্রে, সজ্জিত, কাজেই ওদের মত যদি আমাদের আধুনিক অস্ত্র থাকত তো বুঝিয়ে দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা কত দুর্বার।’ 

-বিপ্লবী বাংলাদেশ, ১০ অক্টোবর, ১৯৭১
* * * * *

রণাঙ্গনের খবর

(রনবার্তা পরিবেশক)

 বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ এক তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত হইয়াছে। দখলকৃত এলাকার সকল স্থানে সকল স্তরে মুক্তিযোদ্ধারা তাহাদের অবস্থান দিন দিন সুদৃঢ় করিয়া চলিয়াছেন।

 দখলীকৃত এলাকার প্রতিটি জেলা সদর দপ্তরসহ জেলার সর্বত্র তাঁহারা বিপুলসংখ্যায় ছড়াইয়া পড়িয়া দিকে দিকে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া শত্রদের খতম, জখম এবং হয়রান করিয়া চলিয়াছেন।