পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (একাদশ খণ্ড).pdf/৭৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



723

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ড

দেশবাসীর উপরে নৃশংস অত্যাচার করে তাদের মনোবল ভাঙতে চেষ্টা করেছে। মুক্তিফৌজের আশ্রয়দাতাদের সন্ধানে তারা গ্রামে গ্রামে হন্যে কুকুরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যে সব গ্রাম মুক্তিফৌজের ঘাঁটি সেগুলিকে তারা জুলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।

 সম্প্রতি রাজশাহীর মীরগঞ্জ, আলাইপুর, চরঘাট, বাঘা প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে রাজাকাররা পাকফৌজের সাহায়তায় আগুন লাগিয়েছে। গত সপ্তাহে আড়ানী, বাওসা, রুস্তমপুর বাজার, কালুহাটি, বাকরা প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে তারা আগুন লাগিয়েছে, খুন করেছে এবং মেয়েদেও ওপরে অমানুষিক অত্যাচার করেছে। সেই অত্যাচাররের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে পৌছেছিল, আর সেই সঙ্গে তাঁরা আরও জেনেছিলেন যে, ডাঃ আইনুদ্দিন, নোহির চেয়ারম্যান, ডাঃ নইমুদ্দিন, এহিয়া, মাসুদ মিয়া এবং আবুল হোসেন এই কয়েকটি পাক-দালালের সংবাদের ভিত্তি করেই তারা এই সব এলাকা বেছে নিয়েছে। মুক্তিফৌজ এই সব অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা ঘাঁটি গেড়েছিলেন আড়ানী কলেজের এক মাইলের মধ্যে। একদিন সকালে তারা দেখতে পেলেন, তাদেরই আশ্রয়দাতাদের বেঁধে নিয়ে চলেছে। পরে তাদেরকে হত্যা করার সংবাদ পেয়েও মুক্তিফৌজের কম্যাণ্ডো কিছু করেননি, তাঁরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

 মুক্তিফৌজের গুপ্তচরেরা খবর নিয়ে এলেন, পরের দিন রাজাকার এবং খান সেনারা বাকরা গ্রামে খানা তল্লাসী চালাবে। মুক্তিফৌজ সেই রাত্রিরেই বাকরা গ্রামের কাছাকাছি একটি গ্রামে ঘাঁটি গাড়লেন। পরের দিন দেখা গেল দুপুরে সাড়ে বারোটার সময় হঠাৎ পাকফৌজ এবং রাজাকাররা তাদের পূর্ব-পরিকল্পনা মত বাকরা বাজর আক্রমণ করল। মুক্তিফৌজও প্রস্তুত ছিল, তাঁরা চক্ষের নিমেষে শক্রবাহিনীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। সেদিনের সেই রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়েছিল মাত্র চল্লিশ-পঞ্চশ গজ দূর থেকে। দিনের আলোয়, বাংলাদেশের সমতলভূমিতে শত্রুর সঙ্গে মুক্তিফৌজের এই সংগ্রাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিফৌজ যখন বীর বিক্রমে শত্রু নিধন করে চলেছে তখন একজন খবর পাঠালেন যে, সারদা থেকে ট্রেনযোগে আরও পচিশজন পাক পাঞ্জাবী ফৌজ আড়ানী রেলব্রীজের কাছে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেদিনের সেই সংগ্রামের অলেখা ইতিহাস বলছে, মুক্তিফৌজের গুলি বৃষ্টির মধ্যে খান সেনারা গুলী ছুড়তে ছুড়তে সারদার দিকে পিছু হটে চলে যায়। সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে দেখা গেল রণক্ষেত্রর প্রায় আধ মাইল জায়গা শত্রুসৈন্যের রক্ত আর শবদেহে সমাকীর্ণ। যে সব মৃতদেহগুলি সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল, তাদর মধ্যে পনেরজন ছিল রাজাকার, একজন পুলিশের বিহারী সুবেদার, ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স ও পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের পাঁচজন এবং আরও বাইশ জনের মৃতদেহ বিক্ষিপ্তভাবে আখের জমিতে বাশবনে, আমবাগানে পড়ে ছিল। তার কিছুদূরে যে মৃতদেহটি পড়ে ছিল সেটি ছিল রাজশাহীর সর্বজনপরিচিত পাক দালাল গোচর আড়ানীর চেয়ারম্যান আবুল হোসেনের লাশ। একটি জীবনও না খুইয়ে মুখোমুখি এত বড় সংগ্রামে বিজয়ী মুক্তিফৌজ সেদিন যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, শক্র মনোবল তেমনি হারিয়ে ফেলেছিল।

 মুক্তিফৌজের সৈনিকেরা রাত্রি শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের মুক্তি অঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন, আর পাক ফৌজ পরের দিন তাদের এই পরাজয়ের উসুল তুলতে বাকরা ও পাল্লা পাড়ায় আগুন লাগিয়েছিল।

মুক্তিফৌজ ২টি সামরিক ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছে

 মুজিবনগর, ২৩ শে অক্টোবর (ইউ, এন, আই)- মুক্তিবাহিনী পূর্বের সংবাদে প্রকাশ, গত পাঁচ দিনে মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া জেলায় ডিনামাইট এবং মাইনের সাহায্যে দুটি সামরিক স্পেশাল ট্রেন এবং একটি গাড়ী উড়িয়ে দিয়েছে এবং অন্ততঃ ৮৩ জন পাক সৈন্য নিহত এবং অপর কয়েকজন আহত হয়েছে।

 গত ২১শে অক্টোবর মেহেরপুরের নিকট কামেদপুর এবং কালাচাঁদপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একজন ক্যাপ্টেনসহ ছ'জন পাকিস্থানী সৈন্য নিহত হয়েছে।