পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (একাদশ খণ্ড).pdf/৭৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



758

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ড

নিয়ে সেগুলিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঘাঁটি তৈরী করেছে। যাতে কিছু দিনও আত্মরক্ষা করা যায়। এবং বাংলাদেশ থেকে যথাসম্ভব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ও কতকগুলি সামরিক সাজসরঞ্জাম সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান প্রধান ঘাঁটিটা করেছে ঢাকায়। এবং ঢাকার বিমানবন্দরকে রক্ষা করার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্যবস্থা করেছে। যশোর, সিলেট, দিনাজপুর শহর থেকে সাফল্যজনকভাবে পিছু হটার ব্যবস্থা নিয়েছে। যে চার পাঁচটি ঘাঁটি পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে তৈরি করতে চাইছে, তার প্রত্যেকটিতে দু’তিন ব্রিগেড করে সৈন্য রাখার পরিকল্পনা করেছে। ঢাকায় অবশ্য প্রায় দু’ডিভিশন সৈন্য রাখা হয়েছে।

 এই চার-পাঁচটি ঘাঁটি থেকে বিমানে করে যথাসম্ভব নিজেদের লোকজন নিরাপত্তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাকিস্তান বুঝেছে জলপথে তারা সুবিধা করতে পারেনা। চালনা এবং মঙ্গলা বন্দরের দিকে এগোলেই মুশকিল, চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা যায় প্রায় অকেজো। প্রত্যেকটা বন্দরে প্রতিপক্ষের কামান ওৎ পেতে আছে।

 পাকিস্তান ইতিমধ্যেই তাদের বিমান বাহিনীর বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়েছে।বাংলাদেশে তাদের স্থান নাই দেখে তারা বিমানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। এবং এইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে বিমান বাহিনীর শক্তি আরও বাড়াচ্ছে। ঢাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পি আইএ স্বাভাবিক যাত্রা বন্ধ করে তাদের নিজেদের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সর্বদা এই বিমান যাতায়াত করছে। পাক কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের দরকার কারণ যাতে তারা এই পলায়ন পর্বটা ভালোভাবে সম্পূর্ণ করতে পারে। তারা বুঝতে পেরেছে স্থল ও জলপথে যাওয়া তাদের বিপদ। পলায়ন পথে যাতে তাদের কোন বিপদ না থাকে তার জন্য ভাল বিমান বন্দর দরকার। এদিকে আবার শক্ত ঘাঁটি যশোর বিমানবন্দর ও ক্যাণ্টনমেণ্ট। কিন্তু তাদের অসুবিধা হয়েছে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের পাশের বিমানবন্দরটি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত। কামানের আঘাতে গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত ওই বিমান ঘাঁটি থেকে বড় জেট বিমান ওড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব। তাই তাদের যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টেও ছাড়তে হচ্ছে।

 পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের পালাবার জন্য অন্তত ৩-৪ সপ্তাহ সময়ের দরকার। ওই সময়টুকুর জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা করবে। কতগুলি ছোট ছোট ঘাঁটি করছে, সেগুলি হচ্ছে মূল ঘাঁটির চতুর্দিকেও কামানের পাল্লার বাহার (অন্তত বিশ মাইল), প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে ওই ছোট ঘাঁটি সাধারণ সৈন্যদের জীবন দিতে হবে। কারণ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন রক্ষা করার জন্য।

ঢাকার উপকণ্ঠ জ্বলছে

 মুজিবনগর, ১লা ডিসেম্বর- মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডোদের আচমকা আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত পাকবাহিনী গতকাল ঢাকা শহরের চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত মুক্ত রাখার জন্য শহরোপকণ্ঠস্থ বহু গ্রামের বাড়ঘর জুলিয়েপুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে এবং প্রায় তিনশত লোককে হত্যা করেছে বলে খবরে প্রকাশ।

 এপির জনৈক ফটোগ্রাফার গতকাল ঢাকার প্রায় ৯ মাইল উত্তরে গ্রাম দেখে এসেছেন। তিনি জানান সৈন্যরা তাকে অন্য গ্রামগুলোতে যেতে বাধা দেয়। ঐ সব গ্রামের সমস্ত বাড়ীঘর নাকি ধ্বংস করা হয়েছে।

 আগুনে পোড়া তিনটি গ্রামে সামান্য যে কয়জন গ্রামবাসী রয়েছেন, তারা বলেন, প্রায় পাঁচশ সৈন্য বৃহস্পতিবার রাত থেকে মোট তিনবার গ্রামগুলোতে ঢুকেছিল। তারা আরো জানান যে, পাক সৈন্যরা সেই সকল অঞ্চলের ঘরবাড়ীর উপর হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। যারা বোমা বিস্ফোরণের পরেও বেঁচে ছিলেন, তারা বন্দুকের গুলিতে অথবা জুলন্ত গৃহের মধ্যে আটক থেকে প্রাণ হারিয়েছেন। উক্ত ফটোগ্রাফার জানান যে, তিনি ঘাস, লতাপাতা ও কাদামাটি দিয়ে ঢাকা বহু মৃতদেহ দেখেছেন।