পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (একাদশ খণ্ড).pdf/৭৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



763

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ড

ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জ হইতে আমাদের প্রতিনিধি লিখিয়াছেন যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা গত ১৪ই নভেম্বর জামালপুর মহকুমার কামালপুরে হানাদার বাহিনীর সহিত ৩৬ ঘণ্টা স্থায়ী এক সংঘর্ষে শতাধিক দুশমনকে হতাহত করেন। উল্লেখযোগ্য যে, কামালপুর খানসেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ভারী মেশিনগান, মর্টারসহ বহু চীনা এবং মার্কিন অস্ত্র হস্তগত করেন। এই দিনই বক্সীগঞ্জ মাদ্রা সড়কে খানসেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালাইয়া তাহারা অর্ধশত খান সেনা খতম করেন। ১৯শে নভেম্বর দেওয়ানগঞ্জ থানার উঠান পাড়ায় অতর্কিত হামলা চালাইয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আরও ১৯ জন হানাদার সৈন্যকে হতাহত করেন। ইহার পর বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সূর্যনগর, উঠানপাড়া এবং মাসীর গ্রাম জ্বালাইয়া দেয়।

 গত ২১শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বাহাদুরাবাদ ঘাটে জঙ্গী সেনাদের রসদ ও অস্ত্রশস্ত্রবাহী দুইটি ষ্টিমার এবং একটি লঞ্চ ধ্বংস করিয়া দেন। এখানে কয়েকজন পাঞ্জাবী সৈন্যেরও সলিল সমাধি হয়।

 ১৭ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নিকট খানসেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালাইয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ৭টি দুই ইঞ্চি মর্টার, একটি ভারী মেশিনগান এবং অন্যান্য বহু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন। এই আক্রমণের সময় দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈন্যদের আকস্মিকভাবে ঘিরিয়া ফেলিলে বেলুচ রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন শাহ্‌ তাহার ১২ জন সঙ্গীসহ আত্মসমর্পণ করে।

 বরিশাল হইতে বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে জানা যায়, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা উজীরপুর, মুলাদী থানা দপ্তর, ভোলা মহকুমার লালমোহন চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন এবং পিরোজপুর মহকুমার স্বরূপকাঠি এবং বানারীপাড়া থানায় হামলা চালাইয়া মোট ২১ জন হানাদার সৈন্য এবং উহাদের অনিয়মিত বাহিনীর ১১৫ জনকে খতম করেন। এই সকল সংঘর্ষের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ৬০টি রাইফেলসহ অস্ত্রশস্ত্র, শক্রবাহিনীর ৩টি লঞ্চ, কয়েকটি গানবোট এবং ২টি বার্জ দখল করিয়া নেয়।

দেশে হাজার হাজার খান সেনা অবরুদ্ধ

\রণবার্তা পরিবেশ \

 বাংলাদেশে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চতুমূখী দুর্বার অগ্রযাত্রার মুখে হাজার হাজার হানাদার পাকিস্তানী কাপুরুষ সৈন্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে অবরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনেই কেন, গোটা বাংলাদেশেই ইহারা এখন অবরুদ্ধ। পলায়নের সকল পথ ইহাদের রুদ্ধ। তাই রণাঙ্গনেই ইহারা মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর নিকট অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করিতেছে দলে দলে।

 বাংলাদেশে হানাদার সৈন্যদের দখলীকৃত সব কয়টি বিমানবন্দরে মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করিয়া দেওয়ায় সকল বিমানঘাঁটিই বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে শত্রর সকল বিমানঘাঁটি এখন অকেজো হইয়া রহিয়াছে। উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যেই দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও এবং সিলেটের শমসের নগর বিমানঘাঁটি দখল করিয়া লইয়াছেন। ফলে বাংলাদেশের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আকাশ পথে চলাচল কিংবা পলায়নের সকল সুযোগ ও সম্ভাবনা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। চতুর্দিক হইতেই হানাদাররা আজ অবরুদ্ধ।

 স্থলভাগেও মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং রেলসেতুগুলি উড়াইয়া দেওয়ায় খানসেনাদের ঘাঁটি হইতে বাহির হইবারও কোন পথ নাই। মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলায় সাতক্ষীরা-খুলনার মধ্যে সড়ক সেতু উড়াইয়া দেওয়ায় এবং সাতক্ষীরা-যশোর ও খুলনা-সাতক্ষীরা রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করিয়া রাখায় সাতক্ষীরা অবস্থান হইতে খানসেনারা হাঁটিয়া যাইতেও পারিতেছে না। যশোর-কুষ্টিয়া সেক্টরে খানসেনাদের অপারেশনাল হেড কোয়ার্টার ঝিনাইদহের মধ্যে রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুক্তিসেনারা দখল করায় খান সেনাদের যশোর-ঝিনাইদহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ফলে ইহারা এখন যশোর হইতে ঢাকা অভিমুখে পলায়নের পথ পাইতেছে না। কুষ্টিয়ার রেল জংশনটিও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসায় ইহারা আর কুষ্টিয়া হইতেও বাহির হইতে পারিবে না।