পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (একাদশ খণ্ড).pdf/৭৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



773

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ড

 ওদিকে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ফেনী হইতে চট্টগ্রামের পথে সীতাকুণ্ঠে গিয়া পৌঁছিয়াছে। খুলনাতে যদিও তীব্র লড়াই চলিতেছে তথাপি দৌলতপুরের পতনের পর হানাদারদের আর তেন মনোবল নাই।

সম্পাদকীয় : নিক্সনের হুমকি ও সপ্তম নৌবহর

 বাংলাদেশ মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। ঢাকা শহরকে শত্রকবল মুক্ত করার জন্য তুমুল যুদ্ধ চলিতেছে। বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদার শত্রকে নিশ্চিহ্ন করার এই চূড়ান্ত সংগ্রামের মুহুর্তে নিক্সন হুমকি দিয়াছে। আক্রমণকারী ইসলামাবাদের জঙ্গিচক্রকে যুদ্ধ বন্ধ করিতে বলার পরিবর্তে নিক্সন ভারতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতেছে। জঙ্গি ইয়াহিয়ার বুট চুম্বনকারী মাও সে তুঙ-এর চীন তার দোসর।

 বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপের জন্য নিক্সন সরকার বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়া দিয়াছে। এইভাবে উনবিংশ শতাব্দীর গানবোট পলিসি আজ নিক্সন সরকার গ্রহণ করিয়াছে। ভারতকে ভয় দেখাইয়া ও হুমকি দিয়া বাংলাদেশের শত্রুর বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির অভিযানকে বানচাল করাই ইহার লক্ষ্য। ইহা নিক্সন সাহেবদের পুরাতন খেলা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ইতালীয় সাধারণ নির্বাচনের সময় আটলাণ্টিক সাগরে ও ভূমধ্যসাগরে আমেরিকা নৌবহর পাঠাইয়াছিল। লেবাননের প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনের সময় ১৯৫৩ সালে ৬ষ্ঠ নৌবহর হইতে বৈরুতে সৈন্য নামাইয়াছিল। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সেখানকার সমুদ্রে বার বার নৌ বহর পাঠাইয়াছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশকে আতুড়ঘরে গলা টিপিয়া মারার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়াছে বাংলাদেশের দরিয়া বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে গলা টিপিয়া মারা তাহার অসাধ্য। তবুও সপ্তম নৌবহর পাঠাইবার পিছনে তাহার আরও একটি উদ্দেশ্য রহিয়াছে তাহা হইল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে দেখানো। এজন্যই বাংলাদেশের মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ও উদ্ধারের জন্য নৌবহর পাঠানো হইয়াছে বলিয়া সাফাই গাহিতেছে। সেখানে পাকিস্তানের করাচী প্রভৃতি শহরের মার্কিন নাগরিকদের বিমানে অপসারণ করা হইয়াছে, যেখানে বাংলাদেশের নৌবহর পাঠানো কেন? বাংলাদেশের ঢাকা শহর হইতে অন্যান্য বিদেশী যাত্রীদের যেভাবে বিমানে অপসারণ করা হইয়াছে তাহারা সে পথে কেন গেলেন না? তাহদের উদ্দেশ্য বিবিধ, হানাদার সৈন্যদের হত্যাবশিষ্টদের রক্ষা করার ‘পবিত্র দায়িত্ব ও তাহারা নিয়াছেন। তাই রাও ফরমান আলির আত্মসমর্পণে ইয়াহিয়া প্রথমে অনুমতি দিয়াছিল কিন্তু পরে মত পাল্টাইয়াছে। সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি পাকিস্তান সরকার পরম উল্লাসের সহিত বার বার ঘোষণায় উল্লেখ করিতেছে।

 প্রথম উদ্দেশ্যের কথা আগেই বলিয়াছি। অপরদিকে ‘কাগজের বাঘে’র নয়া দোস্ত চীন ইয়াহিয়ার পক্ষ লইয়া জাতিসংঘে, নিরাপত্তা পরিষদে আর পিকিং-এর বেতারে ভারতবিরোধী তথা সোভিয়েটবিরোধী কুৎসা চালাইতেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পদে পদে বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে।

 কোথায়গেল তাহার বড় বড় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুলি। সপ্তম নৌবহরের এই গতিবিধিতে চীন নীরব কেন? আমরা চীনকে তার নিজের চরকায় তেল দিতে বলি। দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানে মার্কিন ঘাঁটি তাহার চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যের অভিযান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হাইওয়ান দখল করিয়া রাখিয়াছে তাই নিয়া জাতিসঙ্ঘ ও নিরাপত্তা পরিষদে তাহার গলাবাজী শুনি না। শুনি ভারত নাকি পাকিস্তানের একটা অংশ দখল করিয়া নিতেছে। মহান চীনকে তাহার বর্তমান নেতারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গাধাবোটে পরিণত করিয়াছে।

 তাই মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধির সহিত তাল মিলাইয়া চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে তিব্বতে সৈন্য মোতায়েন করার উদ্যোগ নিয়াছে। তিব্বতে চীনা সৈন্য চলাচলের পিছনে ভারতকে ব্লাকমেইল করার দুরভিসন্ধি রহিয়াছে।



-নতুন বাংলা, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
* * * * *