পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

457 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড বাংলাদেশের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি বাংলার সমগ্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হইতে হইবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন এবং প্রতিটি নাগরিকের মহান কর্তব্য পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের সুমহান ব্রত লইয়া এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। কেননা এই যুদ্ধ সমগ্র জাতির যুদ্ধ, সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। সমগ্র জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আধুনিক অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। এই বাস্তব উপলব্দির ভিত্তিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে আহবান ও নির্দেশ দিয়াছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া ১লা জুন বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, ব্যক্তি, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন একত্রিত হইয়া “বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছে। এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দলমত ও ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেণী-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরূপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানাইতেছি। চূড়ান্ত লক্ষ্য এই সমন্বয় কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হইল বাংলাদেশকে হানাদার দসু্যদের হাত হইতে মুক্তি করিয়া বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি স্বাধীন, সুখী, সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ইহা হইবে এমনই একটি সমাজব্যবস্থা যেখানে যুগ যুগ ধরিয়া শোষিত কৃষক জোতদারীমহাজনী শোষণের নাগপাশ হইতে সত্যিকারের মুক্তিলাভ করিবে, যেখানে জমির উপর তাহার মালিকানা বেকারতের অভিশাপ থাকিবে না, যেখানে ছাত্রের জন্য থাকিবে বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বুদ্ধিজীবীরজন্য থাকিবে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ। প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাকিবে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সমাজ নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিবে। উন্নতমানের কৃষিব্যবস্থা ও শিল্পবিকাশের মাধ্যমে গড়িয়া তুলিবে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি ও একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। এক কথায় এই সমাজব্যবস্থায় সমগ্র জনগণের জন্য থাকিবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাও চিকিৎসা প্রভৃতির নূন্যতম গ্যারান্টি। এই বাংলা হইবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত, দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর বাংলা-জনতার বাংলা। আশু করণীয় উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জন করিবার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত ও সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করিবার কর্মসূচী হইতেছে সমন্বয় কমিটির আশু কর্তব্য। আমাদের এই কর্তব্য মহান ও কঠিন। যেহেতু হানাদারবাহিনী সামরিক দিক দিয়া শক্তিশালী, অন্যদিকে যেহেতু জনগণের হাতে অস্ত্র নাই, সেহেতু এই সমন্বয় কমিটি মনে করে যে গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় ক্রমান্বয়ে শত্রকে দুর্বল করিয়া এবং নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করিয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে। অন্যদিকে যেহেতু হানাদারবাহিনী বিদেশী বর্বর এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার তুলনায় তাহাদের লোকবল অত্যন্ত নগণ্য, সেহেতু এই যুদ্ধে জনগণের জয় যে সুনিশ্চিত সে সম্পর্কেও এই সমন্বয় কমিটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এই সমন্বয় কমিটি আরও মনে করে যে, সমগ্র জনগণের শক্তির পূর্ণ ব্যবহারের উপরই যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে। কোন বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করিয়া নয়, নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াই এই মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইবে। জনতার মধ্য হইতে সশস্ত্র গণফৌজ গড়িয়া তোলার লক্ষ্যকে সম্মুখে রাখিয়া আমাদের গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করিতে হইবে। জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরাই হইবে গণফৌজের মূল শক্তি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল হইবে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের ঘাঁটি। এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে।