পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

479 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড কর্নেল এ, জি. ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি। আপনারা জানেন, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধ জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে একটি অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। রণক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করতে হয় এবং যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায়। যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসীদেশ আক্রমণ করেছিল সেদিন হাজার হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ফরাসী সরকারকেও হিটলারের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। মাত্র ৩ দিনে সব ধ্বংস করে হিটলারের ট্যাংক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থি হয়েছিল। ফরাসী দেশের বীরনায়ক জেনারেল দ্য গল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জেনারেল দ্য গল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্সে বৃটিশের মত শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেও সিঙ্গাপুর থেকে হটে এসে বৰ্মা ত্যাগ করতে হয়েছিল। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করতে হয় যুদ্ধের কলাকৌশল প্রয়োজনে। তাই বাংলার মুক্তিবাহিনী আজকে সাময়িকভাবে যদি কোন রণাঙ্গন থেকে পশ্চাদপসরণ করে তবে তাকে পরাজয় মনে করবেন না। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রণক্ষেত্রে অস্ত্ৰধারণ করেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করার জন্যই অস্ত্ৰধারণ করেছি। জয় আমাদেরই হবেই। আমি জানি, আজকে বাংলার ঘরে ঘরে কী হাহাকার! আমি জানি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আপনাদের বুকের মধ্যে কী ক্ৰন্দনের রোল! আপনারা যখন শোনেন, আপনার শহরে, আপনার গ্রামে, আপনার গঞ্জে যারা তখন কী মৰ্মবেদনায় আপনারা পীড়িত হন। আপনার প্রতিবেশী নারীদেরকে বর্বর পশুরা ইজ্জতের হানি করছে জেনে আপনাদের কলিজা ফেটে যায়। এই ধরনের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সৈন্যবাহিনী কোন দিন করে নাই। নারীর ইজ্জত লুষ্ঠিত হচ্ছে আজ আবার বাংলাদেশে, হত্যা করা হয়েছে দশ লক্ষ নারী, পুরুষ আর শিশুকে। মসজিদ, মন্দির আর গীর্জা ধ্বংস হয়েছে। বাংলার ফসল আজকে মাঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের তরুণদের আজকে হত্যা করা হচ্ছে, গুলি করে মারা হচ্ছে। এই কাহিনীর মর্মবেদনা আপনাদের বুকের ভেতর যেমন বাজে, আমার বুকে যেমন বাজে আর সকলের বুকেও তেমনি বাজে। যদি বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন, তার প্রিয় দেশবাসীর এই মর্মম্ভদ দুঃখে তিনি অধীর হয়ে যেতেন তাদের মুক্তির জন্য। তাই বন্ধুরা! আপনাদের ব্যথা বিশ্ববাসীকে বলার জন্য মন্ত্রীসভার সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁরা কি পর্যন্ত সফল হয়েছেন তার বিচার করবেন আপনারা। কিন্তু একটা জিনিস আপনাদেরকে আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই- আপনারা সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে কাজের অগ্রগতি সম্ভব তার পথ দেখিয়ে দিন। বিশ্ববাসীর কাছে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা আর কূটনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা আমরা এই কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বাংলাদেশে আজ গণহত্যা চলছে। আজকে আপনাদের মন্ত্রিসভা নিরলস চেষ্টা দ্বারা সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে ইয়াহিয়া ভুল আর ভ্রান্ত, আর আমরা সঠিক পথে চলেছি। আজকে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা তা গ্রহণ করেছে। আজকে লন্ডনের “অবজারভার” “সানডে টাইম” বা যে-কোন পত্র-পত্রিকা দেখুন, ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দায় তারা মুখর। যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, “নিউইয়র্ক টাইম” এবং অন্যান্য সমস্ত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলি ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ফরাসীদেশে, ইটালীতে, জার্মানীতে, পত্রিকাগুলি আপনাদের পক্ষে আজকে মত প্রকাশ করে চলেছে।