পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

491 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড ছেলেকে খুন করে মরা ছেলের লাশ বাপকে টানতে বাধ্য করেছে। স্বামীর কোল হতে সতী-সাধবী স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। যে মায়ের গর্ভে আমার জন্ম, যে মায়ের স্তন পান করে আমার বয়ঃবৃদ্ধি, যে মায়ের বুকভরা স্নেহ আমার মনের সম্ভাবনার আলো জুলিয়েছে, যে মা আমার গাল ধরে চুমু খেয়েছে- আজ আমাদের চোখের সামনে সে মায়ের সতীত্ব ভুলুষ্ঠিত হয়েছে। মায়ের মাতৃত্ব, বোনের সতীত্বের মর্যাদা পশুরা দেয় নাই। একটি ঘটনা তোমাদের বলতে চাই- যশোরের এক ক্যাম্পে এক মা পাগলিনির মত আর্তনাদ করছিল। তার সমস্ত শরীর, তার সমস্ত কাপড়ের আঁচল রক্তে ভেজা। মায়ের কাছ যখন গিয়ে শুধালাম, মাগো, তোমার কি হয়েছে- আমার মা তখন আচল সরালো। দেখি তার কোলে মাস তিনেকের একটি শিশুর লাশ বয়নেটের আঘাতে আঘাতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। রক্তে রক্তে তার সমস্ত শরীর লাল হয়ে গেছে। আমরা মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি নাই। মা আমার ডুকরে কেদে উঠে বললো, “আমার তিনমাসের ছেলে তো কোন অপরাধ করে নাই, আমার দুধের বাচ্চা মাসুম কোন অন্যায় করে নাই- কেন তার এ অবস্থা হলো? কেনো আমার চোখের সামনে বিনা অপরাধে এই নির্মমতার শিকার হতে হলো?” আমার দুঃখিনী মা, আমার সন্তানহারা জননী, আমার শোকার্ত জন্মদাত্রী, আমার গর্ভধারিণী ডুকরে কেদে উঠে বললো, “আমি তোমাদের কাছে বিচার চাই, আমার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ চাই।” ংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, মায়ের কোলে শায়িত ঐ কচি ভাইয়ের লাশ ছুয়ে মায়ের কাছে শপথ করেছি, বাংলাদেশে একটি তরুণ যদি বেঁচে থাকে, বাংলাদেশে একটি মুক্তিফৌজ যদি বেঁচে থাকে, দুঃখিনী মায়ের স্তনপান যদি আমরা করে থাকি তবে এর প্রতিশোধ আমরা নেবই। মা, মাগো আমার, ওদেরকে আমরা ক্ষমা করি নাই তুমি বিশ্বাস করো, ওদের রক্তস্নান না করা পর্যন্ত তোমার ছেলেরা ঘরে ফিরবে না। ওদের নির্মুল না করা পর্যন্ত বুলেট আমরা ছুড়বো। জীবন দিয়ে হলেও ওদের আমরা নির্মুল করবোই। সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, যে ঘর আমাদের গপুড়ে গেছে, সৃষ্টির আবীর মাখিয়ে সে ঘর আবার আমরা বাঁধব। যে গ্রাম পুড়ে গেছে- সে গ্রাম আবার গড়ে উঠবে। যে ফসল পুড়ে গেছে- মাটির বুক চিরে সে ফসল আবার আমরা ফলাবো। যে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত হয়েছে, আমার বিশ্বাস, বিদ্যার্থীদের কলগুঞ্জনে আবার সে বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হয়ে উঠবে। কিন্তু যে মা তার তিন মাসের ছেলেকে বিনা অপরাধে হারিয়েছে, শত্রর রক্তে হাত না রাঙালে সে মায়ের কোন সান্তনা নাই। যে মা তার সতীত্ব হারিয়েছেম শত্রকে নিপাত করার আগে সন্তানের দাবী নিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়াতে পারব না। যে বোন সতীত্ব হারানোর বেদনায় আজ গুমরে গুমরে কাঁদছে, পাকিস্তানী শত্রদের হত্যা করার পূর্বে সে বোনের সম্মুখে যাবার কোন অধিকার আমাদের নাই। সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, মাতৃত্বের ঋণ পরিশোধের জন্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমি জানি এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজরাই লড়ছেন না, যে কৃষক গ্রীষ্মের খর রোদে দাঁড়িয়ে হালচাষ করতো তারাও আজ এই মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার। যে শ্রমিক কারখানায় কাজ করতো, এ যুদ্ধের অনুপ্রেরক আজ তারাও। যারা দিনান্তে অফিস করতো, তারাও এ যুদ্ধের শরীক। যে জ্ঞানতাপস জ্ঞানের নিকুঞ্জে নতুন নতুন সম্ভাবনার ফুল ফুটাতো, সে শিক্ষকও আজ মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক। তাই ওদের মারণাস্ত্র থাকতে পারে, আমাদের হিমাচলের মতো অটল জনতা রয়েছে। ওদের কামান থাকতে পারে- কিন্তু আমাদের ঈমান হিমাচলের মতো অটল। ওরা সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। রণাঙ্গনের ফলাফল সে কথাই তো প্রমাণ করে। পচিশ জনার কাছে তিনশ জন মার খেয়ে হটে যাবে কেনো? এত মারণাস্ত্রের দাম্ভিকতা থাকা সত্ত্বেও শত্রসেনারা ২৫ হাজার সৈন্য হারাচ্ছে কেনো- একথা বিশ্ববাসী আজ জানে। সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, এবার রূপসী বাংলা গণ-সমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় পরিণত হয়েছে। বিসুভিয়াসের মতো জুলে উঠেছে- তাই তো গর্বে আজ আমাদের বুক ভরে ওঠে। এতো হুমকির কাছেও যে মানুষ মাথা নত