পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

576 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড ধুয়েমুছে দিয়ে; পরিস্থিতির সর্বনাশা পরিধি ও গভীরত্ব উপলব্ধি করে এবং দেশের মানুষের প্রতি তাঁর বেদনাবিহবল হৃদয়ের বাস্তব রূপ চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করে। -বিশ্বেশ্বর চৌধুরী। রক্তঝরা দিনগুলোতে মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যে রাত্রিতে- হিটলার, নাদিরশাহ, তৈমুরলঙ্গ, চেংগিশ খাঁকে ছড়িয়ে পরিব্যাপ্তি ঘটেছিল যার; এক মাইলাই- এর যে ঘটনা একদিন বিশ্ববাসীকে করে দিয়েছিল স্কন্ধ- বাংলাদেশে সেরকম শত শত মাইলাই সৃষ্টকারী জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকারের শত অপচেষ্টা ব্যর্থ করে আজ বাংলাদেশে উঠেছে নতুন সূর্য। সেই রক্তিম সূর্যের আশায় প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ; উষালগ্নের প্রত্যাশায় অনেকে কাজ করে গেছেন নেপথ্যে। সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত এ অধ্যায়ের শুরুতে কামান, মর্টারের শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত আশেপাশের জনসাধারণ একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসাবে ‘কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দির কে বেছে নিলো। এভাবে জমা হতে লাগলো এদের কেমন করে বাঁচাবো। এ অসহায় লোকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবো কিনা। পরদিন সকালবেলা (২৬শে মার্চ, ’৭১ ইং) কমলাপুর রেল ষ্টেশন থেকে এ দিকটায় শেলিং শুরু হলো। হঠাৎ কয়েকটি এসে পড়লো আমাদের মন্দিরে সীমানায়। প্রাণ হারালো মুটে-মুজুরের ছোট্ট এক মেয়ে আর নাম না জানা দু’জন যুবক। এদিকে দেখতে দেখতে হাজার চারেকের মতো অসহায় নারী-পুরুষ-শিশু মন্দিরে জমা হলো। কেউ কেউ আবার অধিকতর নিরাপত্তার আশায় স্থানান্তরে গমন করতে লাগলো। আমি শেষ পর্যন্ত এ সমস্ত প্রাণের নিশ্চয়াতা বিধানকল্পে ২৮শে মার্চ, ’৭১ ইং তারিখে সেক্রেটারিয়েট ভবনে তদানীন্তন চীফ সেক্রেটারী ও অন্যান্য কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাক্ষাৎ করতে ছুটলাম। সাথে ছিলো আমার প্রিয় শিষ্য শ্রীমান শুদ্ধানন্দ ভিক্ষু ও শ্রীমান জ্ঞানদারঞ্জন বড়ুয়া। পথে বের হয়ে যে ঢাকা নগরীর দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলাম তা টহল দিচ্ছে, আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে মানুষের অগণিত লাশ। এ ছাড়া আর কোন পাবলিক কিম্বা প্রাইভেট যানবাহন সেদিক আমার চোখে পড়েনি। সেক্রেটারিয়েটে হোম সেক্রেটারীর কামরায় ঢুকে দেখলাম চারজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, চিন্তা আর অবসাদে মুখ ভারাক্রান্ত। বৌদ্ধ মন্দিরে চার হাজারের মতো আর্তেও সমাগমের কথা জানিয়ে আমি তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এদের সাহায্য চাইলাম। উত্তরে হোম সেক্রেটারী মান মুখে জবাব দিলেন, “আমার নিজের নিরাপত্তা যেখানে অনিশ্চিত সেখানে আপনার বৌদ্ধ সমাজ কিম্বা আপনার মন্দিরে আশ্রিত লোকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি কি করে। তা ছাড়া আমার হাতে কোন ক্ষমতাও নেই। আমি নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম তবে এক্কেবারে আশা ছাড়লাম না। এপ্রিল মাসের ২তারিখ বেলা দশটার দিকে আমি আমার কামরায় বসে আছি। এমন সময় শুনলাম, মার্শাল ল-এর অর্ডার নিয়ে রেডিও অফিস থেকে তিনজন লোক এসেছেন, সাথে টেপ রেকর্ডার। আমার সাথে দেখা করে বললেন, “আপনাকে একটা বিবৃতি দিতে হবে।” একটু পরেই পুনঃ বললেন “এর জন্যে আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, আমরা কয়েকটা প্রশ্ন এনেছি, আর তার সাথে এনেছি উত্তরটা। আপনি শুধু কণ্ঠটা দেবেন- এই যা৷”- বলে আমার দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। লিপিটুকু পড়ে- আজ বলবো, আমি সেদিন এতো দুঃখের দিনেও মনে মনে না হেসে পারিনি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, যেহেতু আজ আমার মুখ বন্ধ রাখার জন্য কেউ রাইফেল কিম্বা বেয়নেট উচু করে ধরবে না অথবা জোর করে মিথ্যা বলাতে পারবে না; কারণ আজ আমি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক এবং সর্বোপরি আমার চিন্তাধারা মুক্ত। সেদিনের সে