পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

577 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড বিবৃতির নামে অপরূপ প্রহসন পড়ে আমি বলেছিলাম, “আপনাদের এ বানানো উত্তর আমার পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, আমি প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারি; সরকার যদি ইচ্ছা করেন তবে তা প্রচার করতে পারেন।” বৌদ্ধদের অবস্থা কেমন- এরূপ এক প্রশ্নে তা জনতে চাওয়া হলে উত্তরে বলেছিলাম, ”ঢাকা বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থানরত বৌদ্ধ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকের আপাততঃ ভালোই আছেন। ঢাকা শহর কিম্বা প্রদেশের অন্যান্য স্থানের লোকদের অবস্থা কেমন তা প্রদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখতে পারলেই বলবো। তবে সবাই ভালো ও শান্তিতে থাকুক এটাই আমি একান্তভাবে কামনা করি।” এ ছাড়া তখনকার সৃষ্ট অবস্থার জন্যে একমাত্র আওয়ামী লীগই দায়ী বলে বলতে চেয়েছিলেন। আমি এ বলে উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাই যে, আমি রাজনীতি বুঝি না, যেহেতু আমি একজন ধর্মগুরু এবং আমার সংঘ কিম্বা আমি রাজনীতির ধার-ধারি না। মানুষের কল্যাণ কামনাই আমাদের একমাত্র ব্রত। গোলমালের প্রথম দিকে দিন পাঁচেকের মতো আমাদের টেলিফোনের লাইন কাটা ছিলো। এরপর থেকেই চাটগাঁ, পটুয়াখালী, বরিশাল, কুমিল্লা এবং আরও অন্যান্য জায়গা থেকে আমাদের কাছে বার্তা আসতে লাগলো। ঐ মুহুর্তে তারা আমার উপস্থিতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছিলো। এর বেশী কিছু প্রকাশ করার মতো তখন কারো অবস্থা ছিলো না। গ্রামের অবস্থা বুঝতে আমার বেগ পেতে হলো না। ঐ সময়ে আমরা আকাশবাণী’ থেকে প্রচারিত এক খবরে জানতে পারলাম, চট্টগ্রামের রাউজান থানার এক বৌদ্ধ বিহার গোলার আঘাতে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু মারা গেছেন। আমরা প্রায় সব সময়েই ‘আকাশবাণী’ আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ঐ ধরনের খবর শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার প্রাণ ছটফট করছিলো, সংশয়াপন্ন হলাম অনেকের জীবদ্দশা সম্পর্কে দিন যেতে লাগলো, কিন্তু জনসাধারণের সাথে সাক্ষাৎ করার তেমন কোন কার্যকরী ব্যবস্থা করতে পারলাম না। এরপর হঠাৎ মে মাসের পয়লা তারিখে তদানীন্তন গভর্নর টিক্কা খান আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি আমার কর্মী শ্রীজ্ঞানদা রঞ্জন বড়ুয়াকে নিয়ে সাবেক গভর্নর হাউজে গিয়ে উঠলাম। গিয়ে দেখি তৎকালীন চীফ অব ষ্টাফ হামিদ খান আর টিক্কা খান এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে অবস্থান করছে। হামিদ খান আমাকে বললো, “আপনাকে বিদেশে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে পরিভ্রমণে যেতে হবে। এখানে যে আপনারা শান্তিতে আছেন এবং যে সামান্য গগুগোল বেধেছিল তা ঠিক হয়ে গেছে, এটাই বলতে হবে। আমি পাকিস্তানী বৌদ্ধদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবো।” বৌদ্ধদের নিরাপত্তা পাবার কথা শুনে আমি আশান্বিত হলাম; কিন্তু ভাবলাম দেশে যে প্রলয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কিভাবে একটা ডাহা মিথ্যা প্রচারণা চালাবার জন্যি বিদেশে যাবো। একটা সম্প্রদায়কে রক্ষা করার নামে কি করে একটা জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবো। বললাম, “গ্রামের লোকেরা এক্কেবারে হতাশ হয়ে পড়েছে। আমাকে কাছে পাবার জন্যি তারা আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তারা কেউই ঘর থেকে বের হতে পারছে না। আকি দু’একদিনের মধ্যে চাটগাঁ যেতে চাই।” একটা সফরসূচী দাখিল করতে বলবো আমাকে। আমি সম্মতি জানিয়ে ফিরে এলাম। ওখান থেকে ফেরার পর থেকেই মানসিক দুশ্চিন্তায় ভীষণভাবে ভুগছিলাম। ভাবছিলাম আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে। ঐ রাত্রেই আড়াইটার দিকে কুকুরের ডাকে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একটু পরেই কে একজন জানালা দিয়ে আমাকে ডেকে জানালো, সে একটু টেলিফোন করতে চায়। আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ জাগলো। তাকে জানিয়ে দিলাম, এত রাত্রে টেলিফোন দেয়া সম্ভব না। তার অনেক কাকুতি মিনুতির পরও আমি রাজী না হওয়াতে সে চলে যাচ্ছিলো। আঙ্গিনায় তাকে আমাদের কুকুরটা এমনভাবে ধরলো, আমার মনে হলো তাকে বুঝি কামড়িয়ে ছিড়ে ফেলেছে। আমার মনে করুণা জাগলো। থাকতে না পেরে শেষ অবধি আমি দরজা খুললাম। যেই খোলা, অমনি দরজার দু’পাশ থেকে চারজন যুবক আমাকে ধরে ফেললো। দেখলাম, শক্ত করে বেঁধে রাখলো। এরি মধ্যে টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়েছে। চিৎকার করতে বারণ করে একজন আমার দিকে