পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

797 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লী যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছিই রেখে দেওয়া গড়ে তোলা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দফতর পূর্বাঞ্চলের উদ্বাস্ত সমস্যার প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করে তদনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করবে- এমন আশাও দূরাশা। সীমান্তের দূরবর্তী কোন রাজ্যকে একজন শরণার্থীকে ঠাই দেওয়ার জন্যও রাজি করানো যায়নি। শরণার্থীদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কলকাতায় বসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধাগ্রস্ত ঘোষনা থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি অন্যান্য রাজ্যের মনোভাব পাল্টাতে সক্ষম হননি। পশ্চিমবঙ্গের প্রাণান্তকর সমস্যা সম্পর্কে ভারত সরকার কী করতে চান- গত সপ্তাহে রাজনীতি বিষয়ক কমিটির একজন সদস্যকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন, কিসের সমস্যা? ভারত সরকার তো উদ্বাস্ত্তদের সব ব্যয় বহন করছে, সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়। মোট শরণার্থীর মাত্র একতৃতীয়াংশ সরকারী সাহায্য নিচ্ছে, অন্যেরা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের গলগ্রহ হতে বাধ্য হয়েছে- এ কথা তিনি মানতে নারাজ। উনি বললেন- পশ্চিমবঙ্গ যদি মনে করে যে বোঝা খুব ভারী হয়ে পড়ছে, তাহলে সীমান্ত পুনরায় বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কি তা মেনে নেবে? ওঁর কথায় মনে হয়, সমস্যা যেন পশ্চিমবঙ্গেরই। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে ভারত সরকার যে ‘ষ্টান্ড নিয়েছেন তার সঙ্গতি আছে কিনা সেটা তিনি তলিয়ে দেখেননি। রাজনীতি বিষয়ক কমিটিতে এ বিষয়ে শুধু ওঁর একারই মনোভাব নয়। এই উপমহাদেশে রাজীনিতিক মন্থনের ফলে অমৃত এবং বিষ- দুইই উঠছে; পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে শুধু বিষটাই জুটছে। সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়েও রাজ্য ক্ষয়ের মুখে; হাড় পাঁজরা যে কখানা আছে তা বোধ হয় মহামারীর জন্যই রেখে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে বিদেশে চা-পাট পাঠানো বন্ধ করে দেশের জন্য বিদেশী মুদ্রা নিয়ে আসা বন্ধ না করা পর্যন্ত বোধ হয় কেন্দ্র বা স্বচ্ছল রাজ্যগুলির হুস হবে না। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যেসব রাজ্যের গায়ে আঁচড় লাগছে না তাদের বড় চিন্তা পশ্চিমবঙ্গের ভরাডুবির নয়; তাদের চিন্তা শরণার্থীদের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হলে চতুর্থ যোজনার কাজ বানচাল হবে এবং তার ফরে তাদের উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজস্ব স্বার্থের দিকটি বজায় রেখে অগ্রসর হয়ঃ তেমনি বাংলাদেশের সমস্যার মত অবস্থায় ভারতের রাজ্যগুলিও নিজেদের স্বার্থের কথাটাই আগে ভাবছে। শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি। তিনি বোধ হয় বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে না গিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজধানীতে একবার ঘুরে এলে ভালো করতেন। তিনি মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায়ও তাঁর সময়টা কাজে লাগাতে পারতেন। স্বদেশে অনেকের মত পাল্টাবার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি সমস্যার ব্যাপারেও আমরা বোধ হয় উলটপুরাণ গাইছি। শ্রীমতি গান্ধী কলকাতায় বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাক ভারত তা চায় না। ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের মনোভাব। কারণ বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের ছদ্মসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে ভারত ভীত ছিল। যাই হোক, ইয়াহিয়া আক্রমণ শুরু করার পর ভারতের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের সংগ্রামের যথার্থতা অন্যদের বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে যাদের উপর আমরা নির্ভর করে চলি আমরা কি তাদেরই চিন্তাভঙ্গি গ্রহণ করে বসে আছি? ভারত সরকারের বিশ্বাস আর মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্থান আপনা থেকে ধসে পড়বে। এক দিকে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের পাট-চা বিক্রি করে বিদেশী মুদ্রা ঘরে আনা বন্ধ- এই দুইয়ে মিলেই পাকিস্থানের ধ্বংস অনিবার্য করে তুলবে বলে বলা হচ্ছে তা যদি হয়, তাহলে ভারতকেও শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্থান যেন বিদেশী সাহায্যের দ্বারা আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে। ভারতের দূরদেশ বিদেশ পরিক্রমার সেটাও অন্যতম লক্ষ্য। নিরাপদে শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠাবার ব্যাপারে ভারত কী করতে পারবে তা বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মুখপাত্রদের বক্তব্যঃ আগামী মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটিয়ে দিতে না পারলে ওদের বোধ হয় আর কখনোই হটানো যাবে না। তার অর্থ-শরণার্থীদেরও ঘরে ফেরা হবে না।