পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

813 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড যায় না, মন বিষন্ন হয়ে যায়। তাদের পশুবৎ জীবন অবর্ণনীয় দুঃখে শোকে ভয়ে ক্লান্তিতে একদম ভেঙ্গে পড়েছে। কে তাদের আজ মনে বল দেয়, কে তাদের আজ বোঝাতে পারে যে তাদের ভবিষ্যৎ আছে, দেশ আছে কোথাও? বাংলাদেশ- সে আজ কোথায় কতদূরে? বুঝি মৃত্যুর অপর পারে। এদিকে কলেরা মহামারীরূপে উপস্থিত। হাজার করেক প্রাণ ইতিমধ্যেই তার শিকার হয়েছে। হু হু করে এর সংক্রমণ আগুণের মত ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরণার্থী ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও জনপদবাসীরা ভায়ানক এক আতঙ্কগ্রস্ত -এই শীতল মৃত্যু গুলীগোলার মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ত্ৰাস সৃষ্টি করছে। কলেরা নিয়েই অনেক শরণার্থী ঢুকছে, কেননা অভুক্ত অবস্থায় যা তা খেয়েছে, বিষাক্ত জল পান করেছে, নদী নালা বিলে মৃতদেহগুলি পচছে, ভাসছে- সেই জলই খেতে হয়েছে। আর এপারেও যে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানীয় ও খাদ্য মিলছে, তাও তো খুবই কম ছিল। এখানেও কলেরা মাহামারী, বসন্ত প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্র তৈরী ছিল। আজ মৃতদেহ এখানেও সৎকারের কোন ব্যবস্থা নেই, এমনকি মাটিতে কবর দেবার জন্য যথেষ্ট কোদাল পর্যন্ত নেই। জীবিতদের দায়িত্বই কেউ নিতে নই, মৃতদেহের দায়িত্ব নেবে কে, বিশেষ করে সংক্রামক রোগে মৃত ব্যক্তিদের? ফলে এখানেও নদীতে মৃতদেহ নিক্ষেপ করা ছাড়া উপায় নেই। সীমান্ত- বিশেষ করে ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে যে সব শিবির করা হয়েছিল সেগুলির স্থান নির্ণয়ে কোন দূরদৃষ্টি ছিল না, মনে করা হয়েছিল দুদিনের তো ব্যাপার, বাংলাদেশ শীঘ্রই মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, ভারত সরকার নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত হাত লাগবে (নইলে এত সৈন্য সামন্ত এধার ওধার করছে কেন! আসবে সৈন্যরা নিস্ক্রিয় নয়, এমনি একটি ভয় দেখাতে ভাণ করছিল মাত্র কিন্তু ইয়াহিয়া খান আমাদের এই ভানটা ধরে ফেলে- তার যা করার তা করেই যাচ্ছে। কোন দিকে ভ্ৰক্ষেপ না করে)। তাই যেখানে সেখানে শিবির করা হয়, যার প্রায় সবগুলিই খোলা মাঠের নীচু জমিতে। এদিকে বর্ষা এসে গেছে। ক্যাম্পগুলির অধিকাংশই জলে ডুবে যাবে শীঘ্রই কী বীভৎস নোংরা অমানুষিক অবস্থায় পড়বে এই হতভাগ্য মানুষগুলি! মহামারী ও মৃত্যুর মহা ভোজ উপস্থিত। এদিকে নতুন করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসতে শুরু করেছে। সীমান্তের শিবিরে মাথা গুজবার কোন ঠাই নেই। তাদের সংখ্যা গুনবার জন্যও কোন লোক নেই। পশ্চিম বঙ্গের পুনর্বাসন ব্যবস্থা শক্তির বাইরে চলে গেছে। সমগ্র প্রশাসন ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ডাক্তার নেই, সেবক নেই, নার্স নেই, এত স্বেচ্ছাসেবক নেই কোন স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার এর কোন কুল কিনারা করতে পারে। শরণার্থীরা ক্ষুধায়, অনাহারে, মহামারীর ভয়ে হাজারে হাজারে কোলকাতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত মার্চ, পৃথিবীতে যা কেউ কোথাও দেখেনি। প্ৰাণ ভয়ে ভীত লক্ষ পশুবৎ মানুষের মার্চ কোকাতাবাসীরা এবারে আতঙ্কিত, তাদের সুখের নীড় (যদি কিছু সেখানে আজও থেকে থাকে) বুঝি এই আর্ত মানুষদের বন্যায় ও সামাজিক ঝড়ে ভেঙ্গেচুরে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন বুঝি তা তাদের মন্ত্রীত্ব খতম করার জন্য কোন রাজনৈতিক মতলববাজ দল শরণার্থীদের কোলকাতায় আসতে পথ দেখিয়েছে। কী অদ্ভুত আত্নপ্রতারণা। তাদের মন্ত্রীত্ব তারা এমনিতেই রাখতে পারবেন আর কতদিন সে সন্দেহ তাদের নিজেদেরই আছে। কেন আবার একটা মিথ্যা অভিসন্ধি আরোপ করা! অন্যরা এই শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান স্রোতকে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে লাগাচ্ছে, না এরাই লাগাতে চাইছে! কিন্তু হায়, এতে কোন দলেরই কোন রাজনীতি হবে না, কোন লাভ হবে না- গোটা দেশের সব রাজনীতিই এই আর্তজনপ্লাবনে ডুবে যাবে, যাচ্ছেও। পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্দেহে কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোকদের ধরা হয়েছে। জানি না এই অভিযোগ কতটা সত্য। পাকিস্তানী চর গুপ্তাভাবে নানাদিকে কাজ করছে, করবে এতে আর আশ্চর্য কি, তার জন্য যাকে পাও, দোষী বলে জানো ধরো, বিচার করো। কিন্তু আজ তো পাকিস্তান শুধু গোপন ষড়যন্ত্র করছে না, খোলা ষড়যন্ত্র করে কোটিখানেক লোক বারতের ঘাড়ে ফেলে দিচ্ছে- এই অঘোষিত যুদ্ধের জন্য ভারত সরকার অথবা রাজ্যসরকারগুলি কী করছেন? পাকিস্তানের গায়ে হাত দিতে ভয় লাগছে, তাই নয়? আজ ভারত সরকারকে পৃথিবীর কাছে এস ও এস বা রক্ষা কোর রক্ষা কেরা বলে আর্তনাদ করতে বাকী। বাংলাদেশকে রক্ষা করো এই আবেদন আজ তার কাছ থেকে শোনার কোন তাৎপর্য নেই। বাংলাদেশের জন্য