পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

814 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড আর উকীল মোক্তার রাষ্ট্রদূত পৃথিবীর দুয়ারে পাঠাতে হবে না, নিজেকে রক্ষা কেমন করে করবে সে কথাই ভাবুক! আহা পৃথিবীর বিবেক! পৃথিবীর বিবেকের রক্ষাকৰ্ত্ত যারা তাদের একটি হলো আমেরিকা - জাপানে হিরোসিমা ও নাগাসাকীতে পারমানবিক বোমা অকারনেই নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ প্রান যারা মূহুর্তে ধ্বংস করেছিল। ভিয়েতনামে তার কীর্তি তো ঐতিহাসিক। ব্রিটেন আর এক ঐতিহাসিক বিবেকের মূৰ্ত্তি- আহা কী তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এসব বৃহৎ শক্তির ঘরের খবর কি; ইতিহাস কি? আজ উ থান্ট বলছেন পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্ববঙ্গে যা হয়েছে সে জাতীয় ট্রাজেডী নাকি বিরল ! আহা কত দেরীতে এই পরপদলেহী মোটা বেতনভুক্ত কর্মচারীটির ঐতিহাসিক বিবেকজান উপস্থিত হলো ! কয়েক কোটি টাকার আশ্বাস পাওয়া গেছেপৃথিবীর রাজ দরবারগুলো থেকে- ভারত তাই আকাশবাণী মারফৎ এদেশ ও বাংলাদেশের লোককে শুনাচ্ছে। এই কয়েক কোটি টাকার সাহায্য, আসলে ভস্মে ঘি ঢাকার মতও হবে না, উপরন্তু এর বিনিময়ে সাহায্যদাতারা ভারত যাতে কোন কারণেই পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে” হস্তক্ষেপ না করে সে মুচলেকা বা বাধ্যবাধকতা আদায় করে নিচ্ছে। এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা দফতরের ভণিতার অন্ত নেই। ভি সি শুক্লা জানাচ্ছেন, ভারত শীঘ্রই চার দফায় ক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র (ফোর ষ্টেজ রকেট) তৈরী করতে যাচ্ছে- ভারতের আকাশের উপর দিয়ে ভারত মহাসাগরে । এই সময়ে এই তথ্যটি পরিবেশন করার একটা মতলব আছে। পাছে ভারতবাসীরা বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানী বর্বতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বলে, দরকার মত যুদ্ধের দায়িত্ব নেবার দাবী করে- যে দাবী উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। সেই জন্যই আমাদের ভোলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বলে যে আসল শত্ৰতো চীন, তার সঙ্গে যুদ্ধের কথাটা না ভেবে কি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবো ? পাকিস্তান থেকে দেশের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে দেবার জন্যই পার্লামেন্টে এই বীরত্বব্যঞ্জক ঘোষনা রকেট বানাবার (পারমানবিক বোমার রকেট নয়- সাধারন বোমাই) ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। ভারত সরকার আমাদের সত্যিই আহাম্মক মনে করেন। এদিকে প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দ ১১৫০ কোটি টাকা থেকে ১২৫০ কোটিতে টেনে আনা হলো। এত টাকা খরচ করা হচ্ছে কেন, যদি আজ পাকিস্তানের এমন বর্বর আক্রমনের জবাব দিতেও না যাই? আমাদের নাকি বহু অস্ত্রসস্ত্র ও বহু সৈন্যসামন্ত হয়েছে, এমনকি একসঙ্গে ২/৩টি দেশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে পারি বলে মাঝে মাঝে বলা হতো। এখন আর ওসব উচ্চারণও হয় না। ভারত আজ সত্যিই নার্ভাস। যদি এমন দিনেও আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোন কাজে না আসে, তবে এত খরচ করা কেন? সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে যখন যুদ্ধ করানো হচ্ছে না, তখন শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারটাই তাদের তাদর দেওয়া হোক না কেন? তারপর ভারতকে একটি ‘খোলাদেশ’ বা ‘ওপেন কান্ট্রি’ বলেই ঘোষনা করা হোক না কেন? ভারতের চতুর্দিকে যে সব বৃহৎ শক্তি আছে- রুশ, চীন, আমেরিকা, প্রভৃতি তারাই আমাদের ডিফেন্সের ভার নিন, তারা ভাগাভাগি করে নিজেদের শক্তি সাম্যের খাতিরেই হয়তো ভারতকে রক্ষা করে যাবে- যদিও ভারতের তাতে কোন স্বাধীনতা থাকবে না ইজ্জতও থাকবে না, বৃহৎ শক্তিগুলির দাস হয়ে বেশ “সুখের সংসার” নিরাপদে চালাতে থাকবে। হায় জয় হিন্দু, হায় জয় ভারত। কিন্তু আমরা এভাবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার বদলে পরিপূর্ণ আত্নসমর্পণের পথও বোধ হয় গ্রহণ করতে পারবো না। ছোট বড় নানা অহঙ্কারও তো আছে। আপাতত আমরা অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সব রকমের এক নারকীয় দুৰ্গতির মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এত বড় দেশের মালিক হতে চাই, অথচ এক ফোঁটা সাহস আমাদের নেই। এই নির্লজ্জ ভীরুতাকে ঐতিহাসিক বিজ্ঞতা বলে দার্শনিক আত্নপ্রতারণায় নিমগ্ন আছি। ভারতের ইতিহাসে এতবড় লজ্জা ও এত বড় ট্রাজেডী পূর্বে কখনো ঘটেনি। আমরা ডুবে যাচ্ছি। সম্পাদকীয়- কম্পাসঃ ১২ জুন, ১৯৭১