পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

829 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড শিরোনাম সূত্র তারিখ ৩৩৮। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপকৌশল ও কালান্তর ২৫ জুন, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম (সম্পাদকীয়) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপকৌশল ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান ও পরোক্ষ সাহায্য আজ আর গোপন নয়। বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে স্বাধীনতার সংগ্রামকে দমন করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সামরিক সাহায্য করছে না। এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ধর্ম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এতদিন যাবৎ মার্কিন সরকার বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কুম্ভিরাশ্র বিসর্জন করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেছিল। এখন তারা প্রতারকের মুখোশ ফেলে দিয়ে সরাসরি পাকিস্তানী জাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র প্রেরণ করেছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য। পেন্টাগন থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র বোঝাই জাহাজ করাচী অভিমুখে রওনা হয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ যখন ইয়াহিয়া খানের জাতিহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার, যখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে উঠেছে, তখনই মার্কিন সরকার তার ভেক পরিবর্তন করে পাকিস্তানকে সরাসরি সামরিক সাহায্য দানে অগ্রসর হয়েছে। তার চায় পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় ভিয়েতনাম সৃষ্টি করতে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বরণনীতির অংশ। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের পেছনে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে এবং মার্কিন সহায্যপুষ্ট হয়েই যে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার জাতিহত্যা অভিযান চলেছে তা আজ দিবালোকের মতো পরিস্কার। অতএব, এই সত্যের সম্যক উপলব্ধি না হলে, মর্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সর্বপ্রকার প্রত্যাশা পরিত্যাগ না করলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এটা যেমন সার্বজনীন সত্য, তেমনই বাংলাদেশের পক্ষেও সত্য এবং বাস্তব। রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে এ সত্য উপলব্ধির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করছেন বলেই এখনও বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সংহতি বা ঐক্য সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারকে মার্কিনী সামরিক সাহায্যদান নিশ্চয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মোহমুক্ত করবে। বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদেরই ভূত্য ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন যে অপরিহার্য এই সত্যটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। দলমত নির্বিশেষে যাঁরাই মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছে তাঁদের ঐক্যের মধ্যেই সংগ্রামের দুর্বার শক্তি নিহিত রয়েছে। এটাই হল এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা। এই মূল্যবান অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রর বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় ঐক্য ব্যতীত অপর কোন পথ নেই। একমাত্র এই পথেই বাংলার শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় বুর্জোয়ারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। একমাত্র এই পথেই বাংলাদেশের মানুষ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। সার্বিক জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের যে সশস্ত্র বাহিনী সৃষ্টি হবে সেই বাহিনী সাধারণ মানুষের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বাংলার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করবে, শত্রম্নকে নিধন করে মুক্ত অঞ্চল গঠনের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত করবে। এই সার্বিক ঐক্যের পথ হল গণতন্ত্র বিকাশের ঐতিহাসিক পথ। এই ঐক্যের বিনাশ নেই, পরাজয় নেই। একমাত্র এই পথেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে।