পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

863 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড শিরোনাম সূত্র তারিখ ৩৫৯ পূর্ববাংলার বিপন্ন বৌদ্ধেরা আনন্দবাজার পত্রিকা ২২ জুলাই, ১৯৭১ আনন্দবাজার পত্রিকা (সম্পাদকীয়) সম্পাদকীয় পূর্ব বাংলার বিপন্ন বৌদ্ধেরা পূর্ববাংলার নানাস্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে সংখ্যালঘু বৌদ্ধেরা ছিলেন, পাকিস্তানী ফৌজের গুন্ডামি ও বর্বরতায় তাঁরাও অন্যদের মতই নিরাশ্রয় হয়েছেন। তাঁদের মঠ মন্দির ভেঙে, ঘর বাড়ী জুলিয়ে, কুলনারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানী দুষমনরা যে নরকের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে বেঁচে থাকা অসম্ভব। নিছক প্রাণের দায়েই তাই ২০ হাজার বৌদ্ধ ব্ৰক্ষ্মদেশের আরাকান অঞ্চলে জঙ্গলে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ব্ৰক্ষ্মদেশবাসী এক বাঙালি বৌদ্ধই এ সংবাদ জানিয়েছেন আসামের বৌদ্ধপ্রধান শ্রীজিনরতন মহাস্থবিরকে আসামের মিজো পাহাড় অঞ্চলেও নাকি এসেছেন প্রায় ১৫ হাজার বৌদ্ধ এবং তাঁরাও এসেছেন একইভাবে বর্বরতার শিকার হয়ে। আর্ত ও বিপন্ন মানুষেরা যে ধর্ম বা মতাবলম্বীই হন, তাঁদের দিকে আমাদের তাকাতে হবে একই উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সে হিসাবে পূর্ব বাংলার মৃত্তিকা থেকে উন্মলিত লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান নরনারীর সমস্যা থেকে বৌদ্ধদের সমস্যাকে হয়ত তফাৎ করে দেখা চলে না। তবু বঙ্গ ভাষাভাষী বৌদ্ধদের সমস্যার একটা নিজস্ব দিক আছে। তাঁরা শুধু বাংলায় নয় গোটা ভারতেই সংখ্যায় নিতান্তই কম। তাঁদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতিপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য অব্যাহত রেখে তাঁরা এতদিন যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন, তার ভিত্তি হঠাৎ গুড়িয়ে যাওয়ার জন্য তারা অনিবাৰ্যভাবে আজ অকলে পড়েছেন। এই সংকটে তাঁদের জন্যে হাত এগিয়ে দেবার জন্যে তাঁদের স্বগোষ্ঠীর মানুষ আরো অধিক সংখ্যায় থাকলে ভালো হত। ধর্মের আনুষ্ঠানিক অংশ আমরা মানি বা না মানি, তার অন্তলগ্ন ঐক্যের বন্ধনটি যে অদৃশ্যভাবেই কাজ করে তা বোঝা যায়, যখন চরম বিপদের মুহুর্তে ত্রাণের আশায় মানুষ স্বশ্রেণী ও স্বভাষাভাষীর আশ্রয়েই ছুটে আসে। পূর্ববাংলার হিন্দু মুসলমান ভারতে রিক্ত হাতে এলেও এসেছেন এখানকার হিন্দু মুসলমানদের পোষকতার ভরসায়। এই ভরসা নিশ্চয়ই অন্তরে আছে বৌদ্ধদেরও, কারণ বৌদ্ধধর্ম যেহেতু হিন্দুধর্মেরই সম্প্রসারিত একটি শাখা এবং ভারতবর্ষ যেহেতু ‘সেকুলার বা ধর্মের গোঁড়ামি বিমুক্ত রাষ্ট্র, সেই হেতু তাঁরাও এখানে আশ্রয় ও সহায়তা পাবেন। তবু কতকটা নিরূপায়তা বোধ হবেই তাঁদের এবং তার কারণ আমরা গোড়াতেই বলেছি। এদিক থেকে ব্ৰক্ষ্মদেশের পরিবেশ তাঁদের হয়ত খানিকটা অনুকূল হবে । অবশ্য রাজনীতিক শরণার্থীদের সম্বন্ধে সরকারী নীতি সেখানে কি হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আসামে ও পশ্চিম বাংলায় যে বৌদ্ধ শরণার্থীরা এসেছেন, তাঁদের ত্রাণ এবং সেবার কাজে যে আমাদের সতর্ক মনোযোগ আকৃষ্ট হবে, এত অবশ্য কোনই সন্দেহ নেই। একদিন আমরা হিটলারের জার্মানী থেকে ইহুদীদের দলে দলে উৎখাত ও বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। অদম্য প্রাণশক্তি ও বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আত্মপ্রত্যয়ের জোরে তাঁরা চরম দুর্যোগের মধ্যেও টিকে থেকেছেন। এবং তা ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে। বাঙালি বৌদ্ধরাও এইভাবেই জয়ের অধিকারী হবেন একদিন, স্বধর্মদ্রোহী, মানবদ্রোহী আজ জঙ্গী সর্দারদের ক্ষণিকের খেলা শেষ হলে।