পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৩৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

333 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় পত্র এই পর্যুদস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের বিরাট দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। একটি নবজাত স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সে দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে আমাদের পালন করতেই হবে। পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনকে প্রধান দায়িত্ব হিসেবে ধরে নিয়েই রচিত হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার খসড়া। প্রত্যেক বাস্ত্তচু্যত লোক যাতে সসম্মানে ফিরে আসতে পারে এবং তার দখলীকৃত সম্পত্তি ফিরে পায় তার জন্য বাংলাদেশ সরকার শীঘ্রই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যে সমস্ত দুস্কৃতকারী অন্যের বাড়ঘর জবরদখর করেছে তাদের কঠোর শাস্তি পেতেই হবে। কেউই তাদের রক্ষা করতে পারবে না। যুদ্ধের কারণে অনেক নাগরিককে তাদের অস্থাবর সম্পত্তি অরক্ষিত অবস্থায় রেখে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এইসব সম্পত্তি যদি কেউ নিজের স্বার্থে বেদখল করতে চেষ্টা করে তবে তাকেও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি কেউ সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে কোন সম্পত্তি লা-ওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে আছে এবং নষ্ট হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে তবে তিনি যেন নিকটবর্তী থানা সেক্টর বা সাবসেক্টর অথবা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রদাত্ত ব্যক্তি বা কর্মচারীর কাছে তা জমা দেবার ব্যবস্থা করেন। প্রকৃত মালিককে এগুলো ফিরিযে দেবার ব্যবস্থা যথাসময়ে করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামো হবে সমাজতান্ত্রিক। এ কাঠামোর ভিত্তিতে আমরা গড়ে তুলব এমন এক সুখী-সমৃদ্ধ দেশ যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। যেখানে শ্রমিক পাবে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য, কৃষক পাবে তার ফসলের ন্যায্য অধিকার। অথ্যনৈতিক বৈষম্যের প্রাচীর রুদ্ধ করবে না মানুষের দক্ষতা এবং প্রতিভা বিকাশের পথ। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যেমন প্রতিটি পরিবারের দান রয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে যেমনিভাবে প্রত্যেকটি সক্ষম নাগরিককে অংশ নিতে হবে, তেমনি বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির ফসলেও থাকবে সমান অধিকার। এক শ্রেণীকে শোষণ করে আরেক শ্রেণী ফেপে উঠবে এমন অর্থনৈতিক অনাচার বাংলাদেশের মাটিতে বরদাস্ত করা হবে না। বন্ধুগন, মনে রাখবেন জনসম্পদই একটি জাতির সবচাইতে বড় সম্পদ। বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র দসু্য-বিধ্বস্ত দেশের পক্ষে এ উক্তি আরো বেশী সত্য। পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের যে বিরাট কাজ শুরু হয়েছে তা শ্রমই বস্তুতঃ পুঁজি হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সম্মিলিত শ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশের প্রত্যকটি মানুষ যেমনিভাবে এতদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কাজ করে আসছে ঠিক তেমনিভাবে আজ প্রত্যেকটি বাংগালীকে হতে হবে এক-একজন কর্মঠ পুনর্গঠক। দ্রুত এবং সুষ্ঠ পুনর্গঠনের পূর্বশর্ত পূর্ণ নিয়ম ও শৃঙ্খলা। তাই মুক্তাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রেখে স্বাভাবিক অথ্যনৈতিক কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান এবং অনুরোধ, জাতি গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে আপনাদের সমস্ত সময় ও শক্তি জনগণের সেবায় নিয়োজিত করুন। মনে রাখবেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ আটমাস ধরে হানাদর সৈন্যদের গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছেঃ বিনিদ্র রজনীর কষ্ট করতে হয়েছে। প্রায় এক কোটি মানুষকে পৈতৃক বাস্তভিটা ত্যাগ করে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এদের অভাব-দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। আপনাদেরকে পরম সহানুভূতি এবং সমবেদনা সহকারে এসব লোকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলার কৃষক শ্রমিক সবার কাছেই আমার আবেদন তারা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ নিজ কাজে যোগ দিয়ে জাতীয় সম্পদ এবং উৎপাদন বাড়িয়ে তোলেন। মিল-মালিকদের কাছে আমর অনুরোধ, যত শিগগির সম্ভব কলকারখানা চালু করুন, যাতে শ্রমিকরা আপন কাজে যোগ দিতে পারে এবং জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি হতে পারে।