পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৮৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

867 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় পত্র ১৬ই ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ যেন মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে বাংলার অজেয় ভাইবোনেরা, আচ্ছালামু আলায়কুম ! রক্তাক্ত একটা ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসে পৌছেছি। বাঙালীর রক্তে গড়া লোহিত-সাগরের অতল তল থেকে একটা নতুন জাতি জন্ম নিয়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। নাম তার বাংলাদেশ। শত সহস্র তরুণের বুকের রক্ত বাংলার শ্যামল মাটির বুকে অমিত ও অজেয় বিক্রমের আলপনা একে দিয়েছে। এ রক্তিম আলপনার পাশাপাশি চলেছে আশ্রভেজা কান্নার সোত । সারা বাংলা আজ অশ্ৰুসাগরে ভাসছে। কিন্তু সে অশ্রই শেষ কথা নয়। আশ্রমসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে স্বাধীনতার সূর্য। পূত পবিত্র চিত্তে এ সূর্যকে বরণ করে নিতে হবে হাসিমুখে। আমরা আর কাঁদব না। আমাদের কান্নার সময় নেই। আজকের কর্তব্য স্বাধীনতার দুর্জয় সংগ্রামে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। মরে তাঁরা অমর হয়েছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি এবং যারা পৃথিবীর হলাহল পান করে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি তাদের হয়তো দেয়ার মত আর বেশী কিছু নেই। আসন্ন আগামীর হাতে অনাগত ভবিষ্যতের দায় ও দায়িত্ব তুলে দেয়ার প্রতীক্ষায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করাই আমার মতো মানুষের আজকের কর্তব্য। স্বাধীনতার স্বর্ণফসল আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সুদীর্ঘ ন’টি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দুর্বিষহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রতিটি মানুষ এ দিনগুলো কাটিয়েছেন। পরম করমণাময়ের অপার অনুগ্রহে অচিরেই সেসব নিগ্রহের দিনগুলো দূর হবে আমাদের এ বিশ্বাস আছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ অভূতপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতাকে সুসংহত করার জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হবে সন্দেহাতীতভাবে এ ধারণা আমরা করতে পারি। কিন্ত যেদিন সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হবে সেদিন শুরু হবে আর এক ধরনের সংগ্রাম। সে সংগ্রাম হবে সৃষ্টির সংগ্রাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত একটা দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এ তিনটি বিঘোষিত জাতীয় মৌলনীতির উপর ভিত্তি করে দেশকে পুনর্গঠন করতে হবে। দেশে একটা নতুন সমাজ কাঠামো ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করতে হবে। যে জাতীয় ঐক্য ও সংগঠন আমাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে,সেই একই ঐক্য ও সংগঠন দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার স্বর্নফসল ফলাতে হবে এবং বাংলার ঘরে ঘরে সে ফসল পৌছে দিতে হবে। পতাকার পরিবর্তন নয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট আমরা একবার স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু সে স্বাধীনতা ছিল পতাকার পরিবর্তন। তাই অচিরেই সে স্বাধীনতা হতাশার বালুচরে হারিয়ে গেছে। শোষণের বেদীতে সে স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটেছে। এই যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের প্রমাণ করতে হবে, স্বাধীনতার মানে পতাকা পরিবর্তন নয়। রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রতিশ্রুতিবাহী। এ সত্যটাকে ব্যক্তি, সমষ্টি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে ব্যাপ্ত ও উপস্থাপিত করতে হবে।