পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
83

হতাহত হয়। পাকসেনারে কমপক্ষে ৩ জন অফিসার সহ ২১ জন আহত হয়। পরে খবর পাওয়া যায় যে নিহতদের মধ্যে ১ জন লেঃ কর্ণেলও ছিলেন। এ এ্যামবুশের সময় পাকসেনারা কুমিল্লা বিমানবন্দর হতে তাদের সাথীদের সাহায্যার্থে কামানের সাহায্যে আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলা ছুড়তে থাকে। গোলার মুখে বেশিক্ষন টিকতে না পেরে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি স্থানটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে আসে।

 জুলাই মাসের ১লা তারিখে পাকসেনারা আবার তাদের শালদা নদী ও কসবা অবস্থানের ভিতরে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। সকাল ১০টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনাদের একটি দল কসবার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মন্দভাগের নিকট গাফ্ফারের 'সি' কোম্পানীর সামনে উপস্থিত হয়। দুপুর ১২ টার সময় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের 'সি' কোম্পানী, পাকসেনারা যখন তাদের অবস্থানের সামনে দিয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে পারেনা এবং ছত্রভঙ্গ তাদের মৃতদেহগুলি ফেলেই শালদা নদীর অবস্থানে পালিয়ে যায়। পালানোর পথে আমাদের মর্টারের গোলাও তাদের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮ জন আহত ও ৩ জন নিহত হয়।

 পাক সেনারা জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফেনী থেকে দুটি কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। রাস্তায় তারা “শালদার বাজার” নামক স্থানে সাময়িক অবস্থান নেয়। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের ১টি প্লাটুন ও মর্টারসহ দুপুর দুটার সময় শত্রুদের এ দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। তাদের মনোবল বেলুনিয়ার আগে থেকেই যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া সে সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে সাময়িকভাবে বানানো ট্রেঞ্চগুলোতে থাকাও বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। অতর্কিত আক্রামণের ফলে মেশিনগান এবং মর্টারের গোলাগুলিতে তাদের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। পরে জানা যায় যে, তাদের অন্তত পক্ষে ৩০ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছে। পাকসেনারা এরপর শালদা বাজারের পার্শ্ববর্তী সাহেবনগর ও অন্যান্য গ্রামগুলি থেকে স্থানীয় লোকদের অন্য স্থানে চলে যেতে বলে। মতলববাজার এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে লেঃ মাহবুব পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি মতলব বাজার এলাকায় গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে তারা জানতে পারে মতলব থানাতে পাকিস্তানী পুলিশ এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে এসব পুলিশের অত্যাচারে স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উছেছে। পাকিস্তানী পুলিশেরা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় শাসনকার্য আয়ত্তাধীনে আসার চেষ্টা করছে। আমাদের দলটি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই থানাকে আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা থানা সম্বন্ধে সকল খবর যোগাড় করে। জুলাই মাসের ২ তারিখের রাতে গেরিলা দলটি থানার উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানী পুলিশ এবং রেঞ্জাররা এই আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে ৫ জন পুলিশ নিহত এবং ৭ জন রেঞ্জার আহত হয়। ঠিক এ সময়ে গেরিলাদের নিকট যে হালকা মেশিনগানটি ছিল সেটা খারাপ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে গেরিলারা আক্রমণ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গেরিলাদের ১ জন নিহত হয়। কিন্তু আক্রমণের পর থেকে পাকিস্তানী পুলিশেরা আর থানার বাইরে আসার সাহস পায়নি এবং মতলব থানা এলাকা মুক্তিবাহিনীর আয়ত্বাধীনে এসে যায়।

 শালদা নদীতে আমাপদের কার্যকলাপ সব সময় চালানো হচ্ছিল। মেজর সালেকের এক পেট্রোল পার্টি খবর আনে যে রেলওয়ে সড়কের পূর্ব দিক দিয়ে একটি ছোট রাস্তা পাকসেনারা তাদের শালদা নদী এবং নয়নপুর অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করে। মেজর সালেক ৫জনের একটি ডিমোলিশন পার্টি পাঠিয়ে সেই রাস্তার উপর মাইন পুঁতে দেয়। ৯ই জুলাই সাড়ে ৫ টার সময় পাকিস্তানীদের একটি প্লাটুন শালদা নদী থেকে নয়নপুর যাবার পথে এসব এণ্টি-পার্সোনাল মাইনের উপর পড়ে যায়। মাইন বিস্ফোরণে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে শালদা নদীতে ফিরে আসে।