পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
86

 হোমনাতে হাবিলদার গিয়াসের অধীনে যে মুক্তিবাহিনীর দলটি হোমনা থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়, সেই দলটি এ এলাকাতেই তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এ দলটির কার্যকলাপে পাকবাহিনী নিকটবর্তী সমস্ত থানাগুলিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। পাকসেনারা রাস্তার প্রত্যেকটি সেতুর উপর তাদের কড়া পাহাড়ার বন্দোবস্ত করে। প্রতিটি হাট বাজার এলাকাতেও তারা ক্যাম্প তৈরী করে। এছঅড়া নিকটবর্তী সমস্ত এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ডেকে “শান্তি কমিটি' গড়ার কড়া নির্দেশ দেয়। প্রতিটি এলাকার চেয়ারম্যানকে স্থানীয় লোক নিয়োগ করে পাকসেনাদের অধীনে সামরিক প্রশিক্স নিহেত বাধ্য করে এবং তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। কোন স্থানীয় লোক যদি তাদের নির্দেশমত কাজ করতে অস্বীকার করত, তাদের পাকসেনারা তাদের পিতামাতা বাড়িঘরের ক্ষতি করে বা ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশমত কাজ করাতে বাধ্য করত। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় হাবিলদার গিয়াসের দলটির সঠিক সন্ধান পায় এবং তাদের অবস্থিতি সম্বন্ধে পাকবাহিনীর মন্তব্য আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পাই। তাদের ধারণা ছিল যে হোমনা এবং দাউদকান্দি এলাকাতে কমপক্ষে আমাদের ৬ হাজারেরও বোশি লোক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যে পাকসেনারা কখনও রাতে তাদের ক্যাম্পগুলির বাইরে আসতে সাহস করতো না। এছাড়া কোন সময়েই দলে ভারী না হলে ক্যাম্পের বাইরে টহলে বের হতনা। পাকসেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত মানসিক অবস্থার জন্য আমাদের দলটির নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সপ্তাহে একদিন কি দু'দিন লঞ্চের সাহায্যে পাকসেনাদের এসব ক্যাম্পে রসদ যোগান হত। এ সংবাদ আমাদের দলটি জানতে পারে। ৬ই জুলাই দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত মাসিমপুর বাজারের অর্ধমাইল পশ্চিমে জয়পুর গ্রামে শাখানদীর পাড়ে হাবিলদার গিয়াস তার দলটি নিয়ে পাকসেনাদের জন্য একটি এ্যামবুশ পাতে। সকাল ১০টার সময় পাকসেনাদের দুটি লঞ্চ দাউদকান্দির দিক থেকে গোমতী হয়ে এই শাখানদীতে আসে। লঞ্চগুলি এ্যামবুশেন সামনে এসে পড়তেই আমাদের দলটি অতর্কিতে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। পাকসেনারা নদীর ভিতর থেকে এ্যামবুশ দলটির উপর হামলা না করতে পারায় এবং তীরে অবস্থিত এ্যামবুশ পার্টির তীব্র গোলাগুলিতে লঞ্চগুলির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে লঞ্চগুলি পিছু হটে যায় এবং দাউদকান্দির দিকে পালিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি যে অন্তত ২০/২৫ জন পাকসেনা আহত বা নিহত হয়েছে। লঞ্চগুলি এ্যামবুশের ভিতর পড়ে যাওয়া সত্বেও সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হয়নি, কারন এ্যামবুশ পার্টির নিকট রাইফেল এবং হালকা মেশিনগান ছাড়া বড় অস্ত্র, যেমন রকেট কিম্বা কামান ছিলনা, তবুও এ এ্যামবুশের ফলাফল ছিল আমাদের বিশাল সাফল্য। ফলে পাকসেনারা এ এলাকায় চলাফেরাও কমিয়ে দেয়। এতে আমাদের কর্তৃত্ব ও স্থানীয় লোকের মনোবল আরো বেড়ে যায়। এরপর হোমনা ও দাউদকান্দি থানার জনসাধারণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

 ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানীর একটি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তাদের আমন্ত্রণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনারা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খোলার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যেসব সড়ক সেতু আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম সেগুলি পুনঃনির্মাণ করার চেষ্টা চলছিল। ৯ই জুলাই সকাল ৮টায় আমাদের প্লাটুনটি চৌদ্দগ্রামের উত্তরে সড়কের উপর বালুজুরি ভাঙ্গালপুলের নিকট এ্যামবুশ পাতে। ১১ টার সময় পাকসেনারা একটি সি আর বি ট্রাকে করে এবং দু'টি জিপে রাস্তা দিয়ে আসে এবং ভাঙ্গালপুলের নিকট থামে। পুলটি মেরামত করার কাজের প্রস্তুত চলতে থাকে। ঠিক সে সময় আমাদের এ্যামবুশ পার্টি তাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। এর ফলে পাকসেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ্যামবুশ পার্টির গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা পুলের নিকট থেকে পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পরে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও পাকসেনা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর পাকসেনারা আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরো শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা ৩টার সময় মর্টার, কামান, মেশিনগানের সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আমাদের দলটি সাহসিকতার সাথে এ আক্রমণের মোকাবিলা করে। আমাদের গুলিতে পাকসেনারা পর্যদুস্ত হয়ে ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর বিকেল ৫টায় আক্রমণ