পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
91

গজ কেটে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ সময়ে পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং শ্রমিক এনে রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা চালায়। আমাদের গেরিলারা এইসব পাকিস্তানী রেলওয়ে কর্মচারীদের মেরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে ২৬শে জুলাই পাক বাহিনী একটি কোম্পানীকে চাঁদপুর থেকে এই এলাকায় পাঠায়। পাকসেনাদের এই কোম্পানীটি রেলওয়ে লাইনের সঙ্গে সঙ্গে লাকসামের দিকে অগ্রসর হয়। ঠাকুরবাজারের নিকট আমাদের একটি এ্যামবুশ পার্টি আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। দুপুর ২টার সময় পাকসেনাদের এই কোম্পানীটি যখন এ্যামবুশ অবস্থানের মাঝে আসে তখন আমাদের দলটি তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে পাকসেনাদের একজন জে-সি-ওসহ ২২ জন পাকসেনা আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চাঁদপুর পলায়ন করে। এর পরদিন আমাদের গেরিলারা ‘মধু রেলওয়ে স্টেশনের নিকট রেলওয়ে এবং সড়কসেতু ধ্বংস করে দেয় এবং যে পাকিস্তানী ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্শনের জন্য আসে, তাকেও আহত করে।

 আমাদের ঢাকার গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। বৃটিশ সরকারের একটি পার্লামেণ্টারী দল বাংলাদেশের সে সময়ের পরিস্থিতি সরেজমিনে জানার জন্য ঢাকায় আসে। এই দলটি ঢাকা ইণ্টারকণ্টিনেণ্টাল হোটেলে অবস্থান করছিল। ২৪শে জুন সকাল সাড়ে সাতটায় হোটেলের ভিতরে লবীতে বসে বিমান বন্দরে যাবার অপেক্ষা করছিল। ঠিক সে সময় আমাদের ৩জন গেরিলা হোটেলের সামনে বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরিষদীয় দলটিকে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করায়। এর ক'দিন পর আমাদের গেরিলারা জানতে পারে যে নারিন্দার 'গৌরিমা মন্দিরে' পাকিস্তানীদের অনেক দালাল সমবেত হয়ে আলোচনার আয়োজন করছে। দালালেরা যখন আলোচনায় ব্যাস্ত, ঠিক সেইসময় আমাদের গেরিলারা আলোচনা সভায় একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন পাক দালাল হতাহত হয়। ঢাকার গেরিলা দল টিএণ্ডটি বিভাগের একজন পাকিস্তানী ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর গাড়ীত এম-১৪ মাইন দিয়ে বুবিট্র্যাপ লাগিয়ে রাখে। ফলে পাকিস্তানী অফিসারটি গাড়ীসুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানী অফিসাররা মাঝে মাঝে ধানমণ্ডির ‘সাংহাই' চাইনিজ রেষ্টুরেণ্টে সন্ধ্যাভোজে আসত। এ সংবাদ পাবার পর আমাদের ১টি গেরিলা দল ৮ই জুলাই রাত ৯টায় পাকিস্তানী অফিসাররা সেখানে আসলে তাদের উপর গ্রেনেড ছোড়ে। ফলে২/৩ জন পাকিস্তানী অফিসার নিহত হয়। পাকিস্তানী পুলিশরা এ সময়ে রাতে ট্যাক্সিতে কিংবা জীপে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পেট্রোলিং করত। এসব টহলদার পাকিস্তানী পুলিশদের এ্যামবুশ করার জন্য ঢাকার গেরিলদল একটি পরিকল্পনা নেয়। তাদের গতিবিধি সম্বন্ধে সম্পুর্ণ খবরাখবর নেয়া হয়। ১০ই জুলাই ১টি পাকিস্তানী টহলদার পুলিশ পার্টি ধানমণ্ডি রাস্তা নং ২-এর দিক যাচ্ছিল। গেরিলাদের একটি পার্টি তাদের পিছু নেয়। পুলিশদের পেট্রোলটি ২ নং রাস্তার মোড়ে যখন তাদের গতি কমিয়ে দেয়, ঠিক সে সময় গেরিলারা পুলিশের গাড়ীতে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে একজন অফিসারসহ ৫ জন পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হয়। আমাদের গেরিলা দলটি নিরাপদে সে স্থান পরিত্যাগ করে। এর কদিন পর আমাদের আর একটি গেরিলা দল নিউ বেইলী রোডে পাক বাহিনীর একটি জীপের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৩/৪ জন পাক সেনা নিহত হয় এবং জীপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলা দলটি পোস্ট অফিসের ভিতর বিস্ফোরণ ঘটায় এবং মণ্ডলপাড়া ও চৌধুরীবাড়ী ইলেক্ট্রিক সাবস্টেশনটি ১২ই জুলাই রাত সাড়ে ১০ টার সময় ধ্বংস হয়। এ ছাড়া সিদ্ধিরনগর ও আশুগঞ্জের সাথে একটি বৈদ্যুতিক পাইলন উড়িয়ে দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ এবং নরসিংদীর মাঝে দুটি বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে কাঞ্চন এবং কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে পাগলা রেলওয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে নারায়নগঞ্জ এবং ঢাকার মাঝে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে আমার হেডকোয়ার্টারে খবর আসে যে, পাক সরকার পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরীক্ষাকে বানচাল করে দেয়ার জন্য আমরাও একটা পরিকল্পনা নিই। এই পরিকল্পনানুযায়ী আমার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার গেরিলা