পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
99

শালদা নদীতে আমাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ পুরা জুলাই মাস চলতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদা নদীর শত্রু অবস্থানটির উত্তর দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের 'সি' কোম্পানী মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। এদিকে দক্ষিণ দিকে আগরতলা ও কাটামোড়ায় মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের 'এ' কোম্পানী দিয়ে পাকসেনাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের পিছন থেকে সরবরাহের রাস্তা একমাত্র নদী ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। নদীপথেই লুকিয়ে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানে রসদপত্র সরবরাহ করা হতো। এই সরবরাহ পথে পাকসেনাদের এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১টার সময় ৭-৮টি নৌকায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্য ও অন্যান্য সরবরাহসহ পাকসেনারা তাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। নৈাকাগুলি যখন এ্যামবুশ অবস্থানের ভিতরে আসে আমাদের প্লাটুনটি মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচটি নৌকা ডুবে যায়। পাকসেনারাও পিছন হতে পাল্টা গোলাগুলি শুরু করে। সংঘর্ষ প্রায় অর্ধ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। এরপর পাকসেনাদের পিছনের নৌকাগুলি ফেরত চলে যায়। এই সংঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৬০-৭০ জন হতাহত হয়, ৪-৫টি নৌকা ডুবে যায় এবং অনেক রসদ নষ্ট হয়। নৌকার আরোহী পাকসেনারা ডুবে যায়। পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয়।

 কুমিল্লার উত্তরে কালামছড়ি চা বাগানের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এখানে মাসাধিককাল ধরে পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে পাকসেনারা কালামছড়ি চা বাগান অবস্থানে বাঙ্কার তৈরী করে। ২রা আগস্ট রাত ১২টার সময় লেঃ হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একাটি ক্ষুদ্র দল শত্রুঅবস্থানের উপর হামলা চালায়। পাকসেনাদের এক কোম্পানী সৈন্য কামান এবং মর্টারের সহায়তায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। ২রা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অমর সাহসী ক্ষুদ্র দলটি হ্যাণ্ড গ্রেনেড ও ৩০৩ রাইফেলের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। গ্রেনেড বিস্ফেরেণ ঘটিয়ে শত্রুদের ১০টি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ৫০ জন নিহত সঙ্গীকে ফেলে পিছনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও গ্রামের লোক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। দুজন পাকসেনা আমাদের হাতের বন্দি হয়। এমজিআইএ ও মেশিনগানসহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং ২০-২৫ হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। এ ছাড়া অনেক খাদ্যসামগ্রী ও কাপড় আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের পক্ষে দুজন মুক্তিসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে নোয়াখালীতে অপারেশনের জন্য ১৪ জন গণবাহিনীর গেরিলা গোপনপথে চৌদ্দগ্রামের আলকরা বাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। রাত ১টার সময় বাজারের নিকটে শত্রুদের একটি দল অতর্কিতে গেরিলাদের উপর আক্রিমণ চালায়। আমাদের গেরিলারা সাহসের সঙ্গে আক্রমণের মোকাবিলা করে; কিন্তু শত্রুদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে টিছু হটতে বাধ্য হয়। সংঘর্ষে আমাদের একজন গেরিলা নিহত ও কয়েকজন আহত হয় এবং বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে তারা পালিয়ে আসে। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে যে দলটি হোমনা থানায় অবস্থান করছিল, সেই দলটি ২৮শে জুলাই রাতে হোমনা থানার সাঘুটিয়া (হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, রামচন্দ্রপুরের সঙ্গমস্থল) লঞ্চঘাটে পাকবাহিনীর টহলদার একটি লঞ্চের উপর এ্যামবুশ ফাঁদে আটকা পড়ে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার গিয়াসের দল আকস্মিকভাবে শত্রুদের উপর হামলা চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত পাকসেনারা কোন জবাব দেয় না। দুর্ভাগ্যবশত রকেট লাঞ্চার কাজ না করায় সুবেদার গিয়াসের দল লঞ্চটাকে ডুবাতে সক্ষম হয়নি। ১ ঘণ্টা ধরে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে। পাকসেনারা বিক্ষিপ্তভাবে মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। সুবেদার গিয়াসের দলের এত কোন ক্ষতি হয়নি। ১ ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকসেনাদের লঞ্চটি পালিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছে ধাওয়া করে। পাকসেনাদের হতাহতরে সংবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্যজানা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ, ক্ষতবিক্ষত লঞ্চটি দেড় ঘণ্টা হোমনা থানার ঘাটে নোঙর করে থাকে। সেখানে বেশকিছু আহতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং অবশেষে অনেক মৃতদেহসহ লঞ্চটি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। জুলাই মাসে পাকসেনারা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা