পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
102

 লেঃ ইমামুজ্জামানের ‘রেকি' পার্টি সংবাদ নিয়ে আসে যে, পাকসেনাদের দুটি জীপকে রেশন এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বালিয়াজুরি ভাঙ্গা ব্রীজের নিকট শত্রু অবস্থানের দিকে যেতে দেখা গেছে। লেঃ ইমামুজ্জামান তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন জীপ দুটিকে এ্যামবুশ করার জন্য হরিসর্দার বালিয়াজুরি ব্রীজের নিকট পাঠিয়ে দেয়। লেঃ ইমামুজ্জামান প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে জীপের উপর রাইফেলের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের দুজন নিহত হয়। একটি জীপ মৃত সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত ঘুরে পালিয়ে যায়। অন্য জীপটির উপর প্লাটুনটি গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থান নিয়ে আমাদের প্লাটুনটির উপর গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলি ফুরিয়ে এলে তারা গাড়ি থেকে গুলি নেবার চেষ্টা করে -কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ আক্রমণে তাদের ৬ জন মারা যায়। পরে পাকসেনারা আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলা ছুড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুদের গাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দর দুপুর দেড়টার সময় আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি যখন আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের নিকট পৌঁছে, তখন আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড সংঘর্ষে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ফেরত চলে যায়।

 মেজর সালেক ১০ই আগস্ট একটি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া -কুমিল্লা সি এণ্ড-বি রাস্তার নিকট শিলদাই গ্রামে তাঁর গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। পরদিন স্থানীয় লোকের নিকট খবর পায় যে, সি-এণ্ড-বি রাস্তার উপর দিয়ে প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে উজানিরশার পাক অবস্থানে ৩-৪টি জীপ যাতায়াত করে। এই সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক পাকসেনাদের জন্য সি-এণ্ড-বি রাস্তায় একটা এ্যামবুশ পাতে। সমস্ত দিন ও রাত অপেক্ষা করার পরেও পাকসেনারা সেদিন আর আসেনি। বোঝা গেল যে, হয়তো বা তাদের কোন দালাল বা রাজাকার আগে থেকেই এ্যামবুশ সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়ছিল। অনেক অপেক্ষা করার পর রাস্তার মাইন লাগিয়ে মেজর সালেকের দলটি তার ঘাঁটিতে রওয়ানা হয়। পথে রসুল গ্রামের নিকট একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় ক্যাম্প ভবনের ভিতর বেশ কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এই আক্রমনের ফলে ২০ জন রাজাকার নিহত ও ৩০ জন বন্দি হয়। এরপর দলটি নিজেদের অবস্থান নিরাপদে ফিরে আসে।

 শালদা নদী, মন্দভাগ এবং এর চতুর্দিকে আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানীদের ওপর প্রায়ই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যাও দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের আক্রমণের ফলাফল সম্বন্ধে দুটি সঠিক বিবরণ গ্রামবাসী মারফত জানতে পাই। শালদা নদীর শত্রু অবস্থানের উপর আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় গোলার আক্রমণ চালানোর ফলে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুপক্ষের অন্তত ৬০ জন নিহত হয়।বাধ্য হয়ে শত্ররা স্টেশন ছেড়ে নয়ানপুর গ্রাম, শালদা নদী গোডাউন ইত্যাদি এলাকায় অবস্থান তৈরী করে। মন্দভাগেও শত্রু অবস্থানের ওপর আমাদের গোলার আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের প্রায় ১৫০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি ১২০ এমএম মর্টারের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। সন্ত্রস্ত পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের কামানের অবস্থানের পিছু হটিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া নিয়ে যায়। আমাদের এ্যামবুশের ফলে শালদা নদীর রাস্তা পরিত্যাগ করা নাগাইশ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে একটি নতুন রাস্তা খোলার চেষ্টা করে। ১১ই আগস্ট পাকসেনাদের একটি কোম্পানী এই নতুন রাস্তায় আসে। আসার পথে নাগাইশ গ্রাম থেকে একজন স্থানীয় লোককে পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়ে আসে। এই লোকটি পরে আমাদের জানায় যে, পাকসেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। নৌকাতে আসার সময় অনেক সৈন্যই সামনে অগ্রসরে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাদের কমাণ্ডারা অনেকভাবে তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা চালায়। এ ছাড়াও তাদের অনেককে চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তারা তাদের পুরনো দাম্ভিক স্বভাব অনেকটা পরিত্যাগ করেছে। পাকসেনারা গ্রামবাসীদের সাথে মিশবার চেষ্টাও করছিল। শত্রুদের এই নতুন রাস্তার খবর পেয়ে মেজর সালেক একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি নাগাইশ গ্রামে পাকসেনাদের দুটি রসদ বোঝাই নৌকা ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নয়ানপুরের দিকে যাচ্ছিল।