পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
103

আমাদের প্লাটুনটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে এবং ১১ জন পাকসেনাকে নিহত করে নৌকাগুলি ডুবিয়ে দেয়।

 কিছুক্ষণ পরে পাকসেনাদের আরও তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়া দিকে যাচ্ছিল। এই নৌকাগুলিকেও আমাদের এ্যামবুশ পার্টি শশিদল গ্রামের নিকট এ্যামবুশ করে এবং এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরদিন পাকসেনাদের দুটি শক্তিশালী প্লাটুন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে নাগাইশের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের প্লাটুনটি সংবাদ পেয়ে সুবেদার নজরুল ও নায়েব সুবেদার মুনিরের নেতৃত্বে পাকসেনাদের এই দলটিকে নাগাইশ পৌঁছার আগেই অতর্কিত আক্রমণ করে ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ১৭ই আগস্ট ব্রাহ্মণপাড়া এই নদীপথ খোলার জন্য পাকসেনাদের একটি বিরাট দল নদীর পাড় দিয়ে অগ্রসর হয়। এবং সঙ্গে সৈন্য বোঝাই তিনটি নৌকাও অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটিকে আমাদের সৈন্যরা আবার এ্যামবুশ করে। এ্যামবুশের ফলে নৌকার আরোহী ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের যে দলটি পাড় দিয়ে আসছিল, তাদের প্রবল চাপে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। পাকসেনারা দুই-তিনবার এ্যামবুশে পড়ার পরও শালদা নদীর নাগাইশ-ব্রাহ্মণপাড়া যোগাযোগপথ খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এই খাল ছাড়া পিছন থেকে শালদা নদীতে সরবরাহের আর কোন রাস্তা ছিল না।

 ১৯শে আগস্ট দুপুর ১২টার সময় পাকসেনাদের তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়া দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই নৌকাগুলি যখন ছোট নাগাইশের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের সৈন্যরা নৌকাগুলির উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা পাল্টা গুলি চালিয়ে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করা চেষ্টা করে; কিন্তু আমাদের সৈন্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে তাদের দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পিছনে ফিরে পাড়ে পৌঁছায়। পাকসেনারা নৌকা থেকে নেমেই আমাদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে। প্রায় চার ঘণ্টা উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলার পর পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ঐদিনই বেলা ১টার সময় আমাদের কামানের গোলায় শালদা নদী গুদামে অবস্থিত পাকসেনাদের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। ফলে আটজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।

 মন্দভাগেও ৪র্থ বেঙ্গলের 'সি' কোম্পানী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের চারটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। ফলে ১১ জন নিহত ও তিনজন আহত হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান পাকবাহিনীর হরিসর্দার হাটের অবস্থানের উপর তাঁর চাপ রেখে যাচ্ছিল। এই চাপের ফলে পাকসেনাদের মনোনল দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিল। এই অবস্থানটিতে বারবার অতর্কিত আক্রমণ এবং এ্যামবুশ চালানোর ফলে পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে সবসময় সজাগ থাকত।

 শত্রুদের এই অবস্থানটি মুক্ত করার জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ভীতসন্ত্রস্ত পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অবস্থানটির নিকটবর্তী এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, পাকসেনাদের এই অবস্থানটির ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আক্রমণ করার জন্য অতিসত্বর হরিসর্দার হাটের দিকে উত্তর থেকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রের দেয়া অনেক কামানও আছে। এ ছাড়াও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। এই ধরনের গুজব প্রায়ই পাকসেনাদের আমানগোণ্ডা অবস্থানের এলাকায় প্রচার করা হচ্ছিল। এর ফলে পাকসেনাদের মনেবলে আরও ভাঙ্গন ধরে। ১৪ই আগস্ট আরও গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসেই এই আক্রমণ চালানো হবে। ১৪ই আগস্ট রাত ১০টার সময় লেঃ ইমামুজ্জামান কয়েকজন সিপাই আমানগোল্ডার নিকটে গিয়ে লাইন পিস্তল এবং ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে ইল্যুমিনেটিং প্যারাচ্যুট বোমা ছোড়া হয় এবং কয়েক রাউণ্ড গুলি চালানো হয়। এর পরদিন আমানগোণ্ডা অবস্থানের নিকট পৌঁছে দেখা গেল যে, পাকসেনারা সমস্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে রাতে ভয়ে পালিয়ে গেছে এবং এলাকাবাসী পাকসেনাদের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে।