পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
106

৪র্থ বেঙ্গলের 'সি' কোম্পানী আগস্ট মাসের শেষের দিকে কুমিল্লার উত্তরে মন্দভাগ এবং সি-এণ্ড-বি সড়কের উপর তাদের কার্যকলাপ জোরদার করে তোলে। ২৩শে আগস্ট রাত ১টায় ক্যাপ্টে গাফফারের নেতৃত্বে দুটি প্লাটুন মন্দভাগ বাজরের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় আমাদের সৈনিকরা গ্রেনেড চার্জ করে পাকসেনাদের চারটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণে পাকসেনাদের অন্তত ২৫ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে দু'জন মারাত্মকভাবে আহত এবং একজন শহীদ হন। ১ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের যোদ্ধার শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। ২৫শে আগস্ট আমাদের একটি ডিমোলিশন পার্টি সি-এণ্ড-বি সড়কের কালামোড়া সেতুতে প্রহরারহ পাকসেনাদের আক্রমণ করে। সেতুটিকে আমাদের দলটি উড়িয়ে দেয়। ঐদিন ভোর ৫টায় পাকসেনাদের একটি জীপ দ্রুতগতিতে বিধ্বস্ত হয় এবং ঐ জীপের আরোহী তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। আমাদের আরেকটি দল সি-এণ্ড-বি রাস্তার উপর একটি এ্যামবুশ পেতে রাখে।

 ২৫শে আগস্ট সকাল ৮টার সময় পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ি এ্যামবুশের আওতায় এলে গাড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং ডজের আরোহী চারজন পাকসেনাকে (একজন হাবিলদার ও নিজন সিপাই) বন্দি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ যান থেকে ছ'টি রাইফেল, ২২৫ রাউণ্ড গুলি, দুটি পিস্তল ও তিনটি গ্রেনেড হন্তগত করে। কুমিল্লার উত্তরে কামবাড়ি ও আম্রতলী এলাকায় পাকসেনারা প্রায়ই টহল দিতে আসত। পাকসেনাদের এই দলটিকে এ্যামবুশ করার জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২৫শে আগস্ট তারিখে আমাদের একটি প্লাটুন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের নেতৃত্বে বিকেল চারটায় মর্টারসহ পাকসেনাদের টহল দেয়া রাস্তার পাশে এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাকসেনাদের একটি কোম্পানী গোমতী পার হয়ে জামবাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। এ্যামবুশের নিকট পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর প্রবলভাবে মর্টারের গুলিবর্ষণ করা হয়। পাকসেনারা এই আকস্মিক আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এ্যামবুশ পার্টি পলায়নপর শত্রুসেনাদের উপর মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের প্রতি আক্রমণ চালায়। এই এ্যামবুশ ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

 পাকসেনারা শালদা নদী এবং নয়নপুরে তাদের সরবরাহ নদীপথে পাঠাতো। তাদের এই নদীপথে বন্ধ করার জন্য প্রায়ই পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হতো। ২৩শে আগস্ট আমাদের এ্যামবুশ পার্টি সেনেবাজারে অবস্থান নিয়েছিল। সকাল এগারটায় পাকসেনাদের একটা নৌকা সেনেরবাজারের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে আসতে থাকে। আমাদের এ্যামবুশ পার্টি দ্রুত শত্রুর নৌকার উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়, অবশিষ্ট সৈন্যরা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি পশ্চিম তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেমে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার তিন দিন পর আমাদের আরেকটি চহলদার দল ব্রাক্ষ্মণপাড়া গ্রামের নিকট পাকসেনাদের ছ'টি নৌকা নয়ানপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। প্রত্যেকটি নৌকায় ছয় থেকে আটজন করে পাকসেনা ছিল। টহলদার দলটি হাবিলদার সৈয়দ আলী আকবরের নেতৃত্বে সেনেরবাজারের নিকট নদীর পশ্চিম তীরে এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। নৌকাগুলি যখন এ্যামুবশের আওতায় আসে তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাগুলোর উপর মেশিনগানের সাহায্যে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথম নৌকাটি গুলির আঘাতে উল্টে যায় এবং তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট তিনজন আরোহী পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। আমাদের আরেকটি দল সুবেদার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পলায়নপর পাকসেনাদেরকে নাগাইশ গ্রামের কাছে আক্রমণ করে এবং তাদের তিনটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এতে আঠারজন পাকসেনা পানিতে ডুবে মারা যায়। শুধু দুটি নৌকা থেকে পাকসেনারা রক্ষা পায় এবং নয়ানপুরের দিকে পলায়ন করে। এই সংঘর্ষে আমাদের ছাত্র গেরিলা আবদুল মতিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে শাহাদৎ বরণ করেন।