পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
112

এবং ৮টি রাইফেল দখল করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে নওয়াবগঞ্জ থানা আমাদের গেরিলারা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সেখানকার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের গেরিলারা লৌহজং, শিবালয়, সিরাজদীখান এবং শ্রীনগর থানাগুলিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক পুলিশ হত্যা করে এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহে শিবালয় থানার গেরিলা দল পাকসেনাদের একটি প্লাটুনকে টহল দেয়ার সময় এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা ঢাকা থেকে আরো সৈন্য এনে শিবালয়ে আমাদের গেরিলা দলটির ঘাঁটিতে ১৭ই সেপ্টেম্বর আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা এবং ১১ জন রাজাকার নিহত হয়।

 ১৯শে সেপ্টেম্বর আমাদের গেরিলারা মালোচিন বাজারে অবস্থানরত পাক পুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করে ১৯ জন পাক পুলিশকে নিহত এবং তিনজনকে আহত করে। ঘোড়াশালের গেরিলা দল ৯ই আগস্ট রাতে আড়াইহাজার থানার নিকটে পুরিন্দা বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনে আক্রমণ চালায়। এই ঘটনার দুই দিন পর সিদ্ধেশ্বরী-ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ক্ষতিসাধন করে। গেরিলা দল মাশরেকী জুট মিলস লিমিটেডের বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। ফলে ঐ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকারখানাগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা রূপগঞ্জের নিকট যে গ্যাসলাইন ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকসেনারা পশ্চিম পাকিস্তানী প্রকৌশলীদের দ্বারা তা মেরামত করে নেয়। এই সংবাদ আমার হেডকোয়ার্টারে যথাসময়ে পৌঁছে। এই গ্যাসলাইনকে পুনরায় ধ্বংস করার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘোড়াশালের গেরিলাদেরকে গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাঝে ক্ষতি করার জন্য নির্দেশ দেই। ঘোড়াশালের নিকট গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাছ দিয়ে গেছে। নির্দেশ অনুযায়ী গেরিলারা লাইনটির পথ গোপনে অনুসন্ধান করে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে নৌকার সাহায্যে নদীর মাঝামাঝি জায়গায় যায় এবং প্রায় ১৫/২০ ফুট পানির নীচে অবস্থিত গ্যাস পাইপে ডিমোলিশন দ্বারা 'ডিলে সুইচ' (বিলম্বে কার্যকরী সুইচ)-এর সাহায্যে পাইপটি উড়িয়ে দেয়। ফলে গ্যাস পাইপের ভিতর পানি ঢুকে যায়। এতে গ্যাস সরবরাহ অনেক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইহাজার থানার গেরিলারা জানতে পারে যে, পাকসেনারা কামানদি চরে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় লোকদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও জানতে পারে যে, পাকসেনারা নিকটস্থ গ্রাম থেকে মেয়েদের তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে ২৯ জন গেরিলার একটি দল ১১ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাঁচজন পাকসেনা এবং ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্প থেকে মেয়েদেরকে উদ্ধার করে তাদের স্ব স্ব বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয়।

 পাকসেনারা সিরাজদীখান থানার আবদুস সালাম নামক আমাদের আকজন গেরিলাকে গ্রেফতার করে তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রায় ৫০ জন গেরিলার একটি দল পরদিন রাত সাড়ে আটটায় এই ক্যাম্পটির উপর আক্রমণ চালায়। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন পাকিস্তানী সুবেদার মেজরসহ কিছুসংখ্যক পাকসেনা, পাক পুলিশ ও রাজাকারকে হতাহত করে আবদুস সালামকে উদ্ধার করে আনে। এই ঘটনার এক দিন পর নওয়াবগঞ্জ থানার গেরিলারা একটি লঞ্চকে (এম এল পয়েণ্টার) পাকসেনা বহন করে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ছ'টার সময় লঞ্চটি যখন গালিমপুরের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের গেরিলারা লঞ্চটির উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে প্রথমেই পাকসেনাদের কিছু লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটিকে পিছু হটিয়ে পাড়ে অবতরণের চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারা আবার তাদের উপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ ২৫ তারিখ দুপুর পর্যন্ত চলে। শেষ পর্যন্ত আমাদের গেলিলারা পাকসেনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পিএসএস ৯১৩৩ ক্যাপ্টেন জাফর আলী খান, সুবেদার আবদুল্লা, ৪৪ জন পাকসেনা এবং একজন বাঙ্গালী পথপ্রদর্শক পুলিশ নিহত হয়। লঞ্চটিকে পরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আমাদের দু'জন গেরিলা আবদুর রহিম এবং মুহম্মদ আলী শহীদ হন। এই