পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
115

দখল করে। এর পর দিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি দলকে মন্দভাগ বাজারের পূর্ব পাশে শালদা নদীতে আক্রমণ করে। পাকসেনাদের এই দলটি নৌকাযোগে মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আক্রমণে একটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা মন্দভাগ, সেনেরহাট, চাঁদলা প্রভৃতি এলাকায় অবস্থিত আমাদের অবস্থানের ওপর তাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে থাকে। ৩০শে আগস্ট বিকাল ৪টার সময় পাকসেনারা চারটি নৌকা বোঝাই করে এসে ছোট চাঁদলার নিকট অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এরপর সেনারা আমাদের অবস্থানের ওপর ব্রাহ্মণপাড়া এবং শাকুটিতে অবস্থিত মর্টার এবং কামানের সহায়তায় চড়াও হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরাও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করে। উল্লেখ্য যে, পাকসেনারা প্রায় তিন কোম্পানী সৈন্যশক্তি নিয়ে এই আক্রমণ পরিচালনা করে। সারা রাত ধরে আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ ৩০জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। 'আমাদের দু'জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর ভাবে এবং ৬ জন সামান্য আহত হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাকসেনারা আমাদের চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দু'দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের পক্ষে অনেক হতাহত হয়- তবে সঠিক ক্ষতির পরিমান জানা সম্ভব হয়নি। পরাজয়ের গ্লানিতে পশ্চাদপসরণকারী পাকসেনারা মনের আক্রোশে ব্রাহ্মণপাড়া, ছোট চাঁদলা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় ও নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। দুই-তিন দিন বিরতির পর পাকসেনারা আবার আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। সেনেরহাট অবস্থানটি দখল করে নেবার জন্য পাকসেনারা সেনেরহাট পশ্চিমে এবং শালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। তারা দু'দিকে থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনাদের সমাবেশের কৌশল দেখে আমরা বুঝতে পারি যে, পাকসেনারা মন্দভাগের পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলকৃত সমস্ত এলাকা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে তাদের পক্ষে কসবা এবং মন্দভাগ পুনর্দখল করা সহজ হবে। পাকসেনাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে আমরা সেনেরহাট অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে তুলি। ৮ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকসেনারা তাদের নয়ঘরে অবস্থিত ১২০ এম এম মর্টার, ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামান এবং শশীদলে অবস্থিত ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।পাকসেনাদের কামানের গোলায় আমাদের বেশকিছু লোক শহীদ ও আহত হয়। পাকসেনাদের রকেট লাঞ্চারের গোলায় আমাদের ৪টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের দেড়শ গজ পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা এতটুকু মনোবল না হারিয়ে বরং দৃঢ়তার সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। আমাদের সৈনিকদের গুলিতে অগ্রসরমান অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। আমাদের মুজিব ব্যাটারী গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের উপর গোলাবর্ষণ করে অনেক পাকসৈন্যকে হতাহত করে। পাকসেনারা সমস্ত দিন তাদের আক্রমন চালিয়ে আমাদের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করতে না পেরে এবং তাদের অনেক হতাহত হওয়াতে সন্ধ্যায় তাদের আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরদিন পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ এবং মইনপুর অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমনও একইভাবে প্রতিহত করা হয়। যাবার পথে পরাজয়ের আক্রোশে সকাল সাতটার সময় পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য প্রবল কামানের গোলার সহায়তায় আমাদের মইনপুরের অবস্থানেরর ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দু'ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনাদেপ্রায় ৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণকেও প্রতিহত করে। আমাদের পক্ষে আমাদের অবস্থানে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈনিকরা সে অবস্থান পরিত্যাগ করে ৬০০ গজ পিছে বায়েকের নিকট জেলা বোর্ডের রাস্তায় নতুন অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা এই অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। তাদের সেই আক্রমণকে আমাদের সৈনিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে