পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
118

অবস্থানগুলোর ওপর এক ঘণ্টাব্যাপী প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে। পাকসেনাদের বিমান হামলা আমাদের সৈনিকদের মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি। তারা তাদের অবস্থান শত্রুর চাপের মুখেও অটল থাকে। পাকসেনাদের সংঘর্ষ উপরোল্লিখিত এলাকায় এর পরেও অব্যাহত থাকে।

 পাকসেনারা এই সেক্টরে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। তাদের অবস্থানগুলোর দিকে পাকসেনাদের অগ্রসর হওয়ার পথে বাধা দেওয়ার জন্য ৪র্থ বেঙ্গলের 'ডি' কোম্পানী ১৬ই সেপ্টম্বর শত্রু অবস্থানের পেছন ভাগে মেহারী গ্রামে একটি এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। ১৭ তারিখ সকাল ৭টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে আমাদের আক্রমণের জন্য মেহারীতে আমাদের এ্যামবুশ-এর নিকট সম্মিলিত হয়। পাকসেনারা সমবেত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। নিজেদের অবস্থানের এত কাছে তারা আক্রান্ত হবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। ফলে এই আকস্মিক আক্রমণে তারা দিকবিদিক হারিয়ে ফেলে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পাক গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলাতে তাদেরকে পালাতে সহায়তা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। এই অ্যামবুশে পাক সেনাদের ২১ জন নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়। আমাদের সৈনিকরা নিরাপদে পিছু হটে আসতে সক্ষম হয়। ঐ দিন রাত্রে আমাদের এই দলটি সায়েদাবাদের নিকট পাকসেনাদের একটা ঘাটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দুটো জীপ ও ১ টি ৩ টন গাড়ী ধ্বংস করে দেয়। এর পরদিন আমাদের রেইডিং পার্টি চারগাছা বাজারের নিকট পাকসেনাদের একটা টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে ২০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা এই সংবাদ পেয়ে তাদের টহলদার দলের সাহায্যার্থে একটি শক্তিশালী দল তিন নৌকা বোঝাই করে চারগাছের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পৌঁছার আগেই আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে শিমরাইলের নিকটে এ্যামবুশ করে দুটি নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দু' নৌকা ভর্তি পাকসেনাদের সবাই নিহত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের ১ জন সৈনিক শহীদ হন। আমাদের সৈনিকদের জন্য এই এলাকার পাকসেনাদের এহেন বিপর্যয়ের ফলে তারা পুনরায় আরো ব্যাপক ভাবে এই এলাকায় সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। এতে আমরা আরেক অসুবিধার সম্মুখীন হই। ঢাকাতে এবং ফরিদপুরে যেসব গেরিলাদের পাঠানো হতো তারা এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাতায়াত করতো। পাকসেনাদের তৎপরতার জন্য সমস্ত অনুপ্রবেশ পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। ২২শে সেপ্টম্বর আমাদের ৬০ জন গেরিলার একটি দল চারটি নৌকায় অনুপ্রবেশের পথে পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দু' টি নৌকা ডুবে যায়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। তিনটি স্টেনগান, চারটি রাইফেল এবং কিছু টাকা ও ১০০০ গুলি পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। গেরিলারা আহত ও শহীদদের নিয়ে আমাদের অবস্থানে ফিরে আসে। এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমি মেজর আইনুদ্দিনকে যে কোন উপায়ে এই এলাকাকে পুনঃমুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেই। তাকে আরেকটি অতিরিক্ত দল দিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে কসবা থেকে নবীনগর পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিই। তাকে আরেকটি অতিরিক্ত দল দিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে কসবা থেকে নবীনগর পর্যন্ত আমাদের তঃপরতা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিই। পাকসেনাদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর বার বার আক্রমণ করে তাদেরকে এই এলাকা থেকে বিতারিত করার জন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়। শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে মেজর আইনুদ্দীন তার তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১০/১২টির মক্তিশালী রেইডিং পার্টি কসবা, সাইদাবাদ, চরগাছা প্রভৃত এলাকাতে পাঠিয়ে দেয়। এই রেইডিং পার্টিগুলো বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের উপ অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০ জনকে আহত করে ও ১টি গাড়ী ধ্বংস করে। আমাদের পুনঃ পুনঃ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে সমস্ত এলাকাতে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। ২৪শ সেপ্টেম্বর সকাল ৭- ৩০টার সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল ১৭টি নৌকায় আমতাদের একটা রেইডিং পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য নবীনগরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের নৌকাগুলো যখন বিদাকোর্ট গ্রামের নিকট পৌছায় তখন আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাঁচটি নৌকা ডুবে যায় এবং অন্তত ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং পঁয়ত্রিশজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সকল আক্রমণে সে এলাকার সমস্ত জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং বিপুল আনন্দে