পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
119

মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অভিনন্দিত করে। এর কয়েকদিন পর ৩রা অক্টোবর পাকসেনাদের একটি লঞ্চ, গোলাবারুদ ও রসদ নিয়ে সাইদাবাদ যাবার পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা মলৃগ্রামে আক্রান্ত হয়। আক্রমণের ফলে লঞ্চটির গোলাবারুদ আগুন লেগে ডুবে যায়। সেই সঙ্গে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। আমাদের চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং দু'জন আহত হয়। এই খবর পেয়ে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আরেকটি লঞ্চযোগে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে পরগাছার নিকট আক্রমণ করে। প্রায় ২-৩ ঘণ্ট যুদ্ধের পর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পালাবার চেষ্টা করে এবং ডুবে যায়। পাকসেনাদের ৭০/৮০ জন নিহত ও আরো অনেক আহত হয়। লঞ্চটিরও বেশ ক্ষতি হয় এবং বহু কষ্টে বাকী সৈন্যদের নিয়ে লঞ্চটি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ঐদিনই বিকেল ৫টার সময় পাকসেনাদের ২০টি নৌকা ও ৩টি স্পীডবোট আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা কসবার নিকট আক্রান্ত হয়। ফলে ৩য় পাঞ্জাবী রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল জামান ও একজন ক্যাপ্টেন সহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তিনটি স্পীড বোট ও কয়েকটি নৌকা ডুবে যায়।

 সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ এই এলাকায় চোট এ্যামবুশ এবং ছোট ছোট আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩রা ও ৪ঠা অক্টোবরে চারগাছা, মহুগ্রাম, কসবা প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনারদের অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ সৈনিক নিহত হয়। একটি লঞ্চ, তিনটি স্পীডবোট, ১০টি নৌকা ডুবে যায় এবং অন্য আরেকটি লঞ্চ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় লক্ষাধিক পরিমাণের গোলাবারুদ পানিতে ডুবে যায় কিংবা আমাদের দখলে আসে। একজন লেঃ কর্ণেলসহ বেশ ক'জন অফিসার নিহত হয়। এর ফলে এই এলাকায় পাকসেনাদের তৎপরতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা অনেক পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।

 কুমিল্লার দক্ষিণে এবং নোয়াখালী এলাকাতেও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তৎপরতা আরো জোরদার করে তোলে। ৩০শে আগষ্ট সকাল ১০টায় লাকসাম থেকে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি আমাদের অবস্থানের ২০০ গজের মধ্যে পৌঁছালে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্ত দিন ধরে গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনারা আক্রোশে রাস্তার চতুর্দিকের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। প্রচণ্ড আক্রমণ সত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে তাদের প্রায় ২০ জন সৈন্য নিহত এবং অনেক আহত হয়। তারা অগ্রসর হতে সক্ষম না হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ল্যান্স নায়েক লোকমান আলী ও ল্যান্স নায়েক আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে একটি ডিমোলিশন পার্টিকে চৌদ্দগ্রাম-বাংগোড়া-লাকসাম রাস্তা দিয়ে শত্রুসৈন্যদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য রাস্তায় মাঝে মাঝে ডিমোলিশন দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। দলটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর তাদের ডিমোলিশন কাজ শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয় শান্তি কমিটি ও তাদের লোকেরা পাকসেনা কর্তৃক প্রতিশোধের ভয়ে রাস্তায় ডিমোলিশন লাগাতে বাধা দেয়। ল্যন্স নায়েক স্থানীয় লোকদেরকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বুঝিয়ে বলেন। বোঝানোর পর শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। তারা নিজেরাই রাস্তা খুঁড়ে তিন জায়গাতে ৫০ পাউণ্ডেং জিলেটিন এক্সপ্লোসিভ-এর ব্যাগ লাগায় এবং ৮০ ফুট রাস্তা উড়িয়ে দেয়। এতে পার্শ্ববর্তী রাস্তার দু'পাশের পানি রাস্তার খাদে প্রবেশ করে। ফলে চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঐদিন রাতে আমাদের আরেকটি টহলদার দল কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্বে আর একটি দল লাঙ্গলকোট ও লাকসামের মাঝামাঝি রেললাইনের উপর মাইন পুঁতে একটি ইঞ্জিনসহ তিনটি রেলওয়ে বগী ধ্বংস করে দেয়। কাজলপুরের নিকট আরেকটি মালবাহী ট্রেন আমাদের পোঁতা মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়। ফেনী ও লাকসামের মাঝে নাওতি স্টেশনের নিকট ডিমোলিশন লাগিয়ে রেললাইনের ১৪ ফুট রাস্তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা- ফেনী রেললাইনের পাশে টেলিফোনের তার কয়েক জায়গায় কেটে দেয়। ৩রা সেপ্টেম্বর আমাদের আর একটি ডিমোলিশন পার্টি লালমাই ও জাঙ্গালিয়া স্টেশনের মাঝে রেলওয়ে রাস্তার উপর ডিমোলিশন লাগিয়ে রেললাইনের খানিকটা উড়িয়ে দেয় এবং জমুয়া ও বেতুরার রেভিনিউ অফিস পুড়িয়ে দেয়।