পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
137

 নিরাপত্তায় বেশ সহায়ক ছিল। এই অবস্থানটিকে নিয়মিত প্রতায় আক্রমণ করে সফল হওয়া দুস্কর ছিল। শত্রুঘাঁটির এই সকল বৈশিষ্ট্য তাদের পক্ষে সহায়ক হওয়ায় আমরা এই ঘাঁটিটিকে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ না করে অনিয়মিত পদ্ধতিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। শত্রুদের ঘাঁটিটি পর্যবেক্ষণের পর আমরা আরো জানতে পারি যে; শালদা নদীর তীর বরারব আমাদের ঠিক সামনে তারা চজারটি বড় পরিখা খনন করেছে। শালদা নদীর গুদামঘরের পাশ দিয়েও তারা একই রকম পরিখা খানন করেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘাঁটিটিকে তিনদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার ও নায়েব সুবেদার সিরাজের নেতৃত্ব একটি প্লাটুন শালদা নদী রেলস্টেশনের পূর্বে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি প্লাটুন শালদা নদী ও গুদামঘরের পশ্চিমে নদী অতিক্রমে করে আবস্থান নেয়। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে আরেটি প্লাটুন শালদা নদীতে শত্রুঘাটির বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়। পাকসোরা যাতে আক্রমণের সময় আমাদের পেছনে থেকে আঘাত না হানতে পারে সেজন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে একটি কোম্পানী মঙ্গল মিয়ার অবস্থানের পেছনে নিরাপত্তামূলক অবস্থান গ্রহন করে। এছাড়া পাকনোদের মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষণ করার জন্য চারটি ছোট রেইডিং পার্টিকে বড় ধুশিয়া; চান্দলা; গোবিন্দপুর; কায়েমপুর প্রভৃতি শত্রুঘাঁটির দিকে পাঠানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এইসব রেইডিং পার্টিগুলো ১৫ই নভেম্বর রাতে পাকসেনাদের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য শত্রুঘাঁটির উপর হালকা আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা শালদী নদী থেকে রেইডিং পার্টির উপর কামান এবং মর্টারের সাহয্যে গোলাবর্ষন করে। এই গোলাবর্ধন সমস্ত রাত ধরে চলে এবং ভোরের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আক্রমণ শেষ হয়ে গেছে ভেবে পাকসেনারা পরদিন সকালে কিছুটা অসতর্ক হয়ে পড়ে এবং বিশ্রামের সুযোগ নেয়। এই সময় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহগুলো রাজাকার এবং ইপকাফ-এর প্রহরাধীন ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শত্রুরা সাধারণত রাতের বেলায় আমাদের সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য যতটা সতর্ক থাকতো; দিনের বেলায় ততোটা প্রস্তুত থাকতো না।

 এমতাবস্থায় আমরা তাদের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে সকাল ৮টার দিকে তাদের উপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রচণ্ড আক্রমণ চালাই।

 সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি পশ্চিম দিক থেকে শালদা নদী গুদামঘরের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর এবং নায়েব সুবেদার রিয়াজ পূর্বদিকের পাহাড়ী এলাকার অবস্থান থেকে শালদা নদী রেলস্টেশন-এর পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপার আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে নায়েব সুবেদার মুহাম্মদ হোসেন সুবেদার বেলায়েতের অবস্থান থেকে নদীর অপর তীরের পরিখাগুলোতে আর-আর-এর সাহায্যে শত্রুদের চারটি পরিখা ধ্বংস করে দেয়। এতে আমাদের যথেষ্ট সুবিধা হয় এবং পাকসেনারা সম্মুখবর্তী পরিখা ছেড়ে পিছু হটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার বেলায়েত তাঁর সৈন্যদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাঁতরিয়ে অপর তীরে শত্রুদের সম্মুখবর্তী পরিত্যক্ত পরিখাগুলো তখল করে নেয় এবং কিছু সৈনিক সেইসব পরিখাতে রেখে সামনের দিকে আরো অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে সুবেদার বেলায়েত শত্রুসেনা কর্তৃক অতর্কিত আক্রান্ত হয়। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সুবেদার বেলায়েত বীরবিক্রমে সম্মুখভাগের শত্রপরিখার উপর গ্রেনেড চার্জকরে আরো কয়েকটি শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করে এবং শত্রুসৈন্য নিহত করে। সুবেদার বেলায়েত ও তাঁর দলের প্রচণ্ড আক্রমণে শালদা নদী তীরবর্তী এলাকা সম্পূর্নরূপে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ফলে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে শালদা নদী গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনাদের যোগাযোগ সম্পূর্নরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এবং তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকসেনারা আমাদের উপর কামান কিংবা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছিলো না। কেননা আমাদের সৈনিক তাদের দু'দলের মধ্যবর্তি স্থানে পৌঁছে যাওয়ায় তাদের গোলাবর্ষণে নিজেদেরই ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা বুঝতে পারে যে তারা দু'দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণের শিকার হয়ে মূল ঘাঁটি থেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং তাদের পক্ষে এই আক্রমণের মুখে বেশীক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই সময় পাকসেনাদের একটি অয়্যারলেস ম্যাসেজ আমাদের কাছে ধরা পড়ে। এতে তারা কর্তৃপক্ষকে জানায় যে “মুক্তি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন তাদের উপর প্রচণ্ড