পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
144

করে। ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনাদের আরো বিতাড়িত করে ময়নামতির পথে রেলওয়ে ক্রসিং এলাকা পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করে। ৯ম বঙ্গলের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লা শহরে অবস্থানরত পাকসেনা ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এই সময়ে হাজার হাজার জনতা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকসেনাদের পেছনে অগ্রসর হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে; পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে এই জেলা শহরটি সর্বপ্রথম মুক্তিবাহিনী কর্তৃক শত্রুমুক্ত হয়। ১০ই ডিসেম্বর ৯ম বেঙ্গল কুমিল্লা শহরের রেলওয়ে ক্রসিং থেকে ময়নামতি ছাউনীর দিকে অগ্রসরহতে থাকে। এই অগ্রাভিযানের সময় মিত্র বাহিনীর তিনটি ট্যাংক ৯ম বেঙ্গলের সহায়তার জন্য মেজর আইনউদ্দিনের কমাণ্ডের অধীনে দেয়া হয়। রেলওয়ে ক্রসিং থেকে দেড় মাইল পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার পর ৯ম বেঙ্গলের অগ্রবর্তী দলগুলি টেক্রটাইল মিল এলাকার সামনে পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হয়। ৯ম বেঙ্গলের আরেকটি কোম্পানী কোর্টবাড়ির পথে ময়নামতির দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিলো। এই দলটি মিল এলাকায় পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হলেও অগ্রবর্তী দলগুলো পাকসেনাদের অবস্থানগুলো দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু একঘণ্টা ‘রেকি করার পর বোঝা যায়, পাকসেনারে অবস্থানগুলো খুবই শক্তিশালী। অবস্থানগুলোতে মেশিনগান এবং ১০৬ আর-আর বাঙ্কারের ভিতর রেখে কুমিল্লা-ময়নামতির রাস্তাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সংবাদ আমাদের অগ্রবর্তী দলগুলো মেজর আইনউদ্দিনকে অবগত করে। মেজর আইনউদ্দিন পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর উপর চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে নিজে আরো সম্মুখবর্তী অবস্থানে এস পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহ করে। সংবাদ সংগ্রহের পর সম্পূর্ন ব্যাটালিয়ান দিয়ে মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কের সহায়তায় আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিন্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ভোরে মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলোকে সড়কের বাঁ দিক দিয়ে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং ৯ম বেঙ্গলকে উত্তর দিক থেকে আক্রমনের পরামর্শ দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিত্র বাহিনী ট্যাঙ্কগুলো রাস্তার দাক্ষণ দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর পাকসেনারা ট্যাঙ্কগুলোর উপর ১০৬ আর আর এর সাহয্যে প্রচণ্ড গোলাবর্ষন করে। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাঙ্ক পাকবাহিনীর গোলায় বিনষ্ট হয়ে যায়। শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ট্যাঙ্কগুলির অগ্রসর হওয়া উচিত নয় ভেবে মেজর আইনউদ্দিন ট্যাঙ্কগুলোকে নিজ নিজ অবস্থানে লুক্কায়িত অবস্থান থেকে পাকসেনাদের বাঙ্কারগুলির উপর আক্রমন চালাবার নির্দেশ দেয়। অপরদিকে ৯ম বেঙ্গল তাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে। এ সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে পাকসেনারা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৫ই ডিসেম্বর সকালে পাকসেনাদের সর্ব বামদিকে সাদা পতাকা উড়ে দেখা যায় এবং কিছুক্ষণ পর সেই জায়গা থেকে গোলাগুলিও বন্ধ হয়। মেজর আইনউদ্দিন সাদা পতাকা দেখে আক্রমণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় এবং শত্রুসেনাদের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়।প্রায় আধঘণ্টাপর গোলগুলির স্তিমিত হয়ে এলে উত্তর দিকের পুকুর পাড়ের উঁচু বাঁধের উপর প্রায় ২৫/৩০ জন পাকসেনাকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সাদা পতাকা হাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়।মেজর আইনউদ্দিন তৎক্ষণাৎ সেইসব পাকসেনাদের আরো সামনে আসতে নির্দেশ দেয়। পাকসেনারা নির্দেশমত মজের আইনউদ্দিনের কাছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পনকরে। এই সময় হাজার হাজার স্থানীয় জনসাধারণ পাকসেনাদের ঘেরাও করে তাদেরকে বেঁধে ফেলে। বাকি পাকসেনারা যারা তখনো বাঁধ থেকে সামনের দিকে আসছিল তারা ভয়ে সামনের দিকে না এসে পেছনের দিকে পালাতে থাকে। মেজর আইনউদ্দিন তাদেরকে পুনরায় আত্মসমর্পণের আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও পাকসেরারা নিজেদের বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। আত্মসমর্পণের আদেশ না মানায় মেজর আইনউদ্দিন ৯ম বেঙ্গলকে পুনরায় আক্রমণের নির্দেশ দেয়। প্রায় ৪০ঘণ্টা আক্রমণের পর শত্রু অবস্থানটি ৯ম বেঙ্গলের হস্তগত হয়। প্রায় ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পন করে।অবশিষ্ট পাকসেনা ময়নামতি ছাউনিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকবাহিনীর ৩৯তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট এই অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। অবস্থানটি শত্রুমুক্তকরার পর ৯ম বেঙ্গল ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রসর হয়-ময়নামতি সেনানিবাসের উপকেণ্ঠ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করে। ৯ম বেঙ্গল পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতরক্ষাব্যূহের সম্মুখীন হয়। পাকসেনারা ময়নামতি সেনানিবাসের উঁচু ভূমির সহায়তায় এই ঘাঁটিটিকে একটি দর্গে পরিণত করেছিল। চতুর্দিকে পরিখা খনন এবং বাঙ্কার তৈরী করে প্রতিরক্ষাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছিল।