পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
152

কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম রাস্তার মাঝে ডিফেন্স নিতে বল্লেন। আমাকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা হলো। আমি ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশ মত ৩ তারিখ রাতে চিওড়া গেলাম। আমরা পৌঁছালে চিওড়া বাজারে ভারতীয় যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ডিফেন্স নিয়েছিল (পূর্ব থেকেই) তারা তখন অন্যত্র চলে গেল। পাক সৈন্যবাহিনী চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে একটি বাজারে ডিফেন্স নিয়েছিল। চিওড়া পৌঁছানোর পর পরই পাকবাহিনী কোন রকম প্রতিরোধ না করেই পিছনের দিকে চলে গেল। ৫ই ডিসেম্বর সকালে বালুতুফা (কুমিল্লা শহরের পূর্ব পাশে) গিয়ে আমি আমার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি যখন বালুতুফা পৌঁছাই তখন সেখানে যে পাকসেনারা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়েছিল তার দূরত্ব ছিল মাত্র আট মাইল। আমি ভাবলাম যে, পাকসেনারা যে পাকা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়েছিল তার দূরত্ব ছিল মাত্র আট মাইল। আমি ভাবলাম যে, পাকসেনারা যে পাকা বাঙ্কারে ডিফেন্স নিয়ে আছে তাদের সরাসরি যুদ্ধ করা অল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে সম্ভবপর নয়। তাই পাকসেনাদের পিছনের দিক দিয়ে কমিল্লা শহরে ৬ই ডিসেম্বর প্রবেশ করি। এর ফলে বালুতুফার পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারপরই আমি আমার বাহিনী নিয়ে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করি। কুমিল্লা শহরের পূর্ব দিক থেকে ঢুকে আমার কনভয় নিয়ে কুমিল্লা শহরের পশ্চিম দিকে ৭ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছলাম। দুপুর বারোটার দিকে আমার সঙ্গে ভারতীয় শিখ জাট-এর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার টমসনের সঙ্গে ব্রীজের কাছে দেখা দেয়। শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের কাজ ছিল কুমিল্লা বিমানবন্দর আক্রমণ করা। শিখ জাট ব্যাটালিয়ন কামণ্ডার বিমানবন্দর আক্রমন করেছিলেন ৬ই ডিসেম্বর রাতে। এই আক্রমণে শিখ জাট সেনাদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা বিমানবন্দর ছেড়ে চলে যায়। আমার কনভয় যখন কুমিল্লা শহরের পশ্চিমদিকে এগুচ্ছিল তখন শহরের হাজার হাজার জনতা আমাদেরকে স্বাগত জানাতে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমি ভাবলাম এ সময় যদি পাকবাহিনী হঠাৎ করে আক্রমণ করে তবে আমার বাহিনীর পক্ষে ভিড়ের ভিতর সুষ্ঠুভাবে কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। এই কথা চিন্তা করে আমি কনভয়ের সামনে এসে জনতাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে এবং সামনে না আসতে অনুরোধ করলাম। আমি আরও বললাম যে, আমরা প্রথমে শহর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করি। কিন্তু জনতা একথা প্রথমে শুনতে নারাজ হওয়াতে বাধ্য হয়েই আমাকে তাদের উপর বলপ্রয়োগ করতে হলো। জনতা শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল। তবে জনতা আমাদের উপর একটু মনঃক্ষুন্ন হলো।

 ৭ই ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটায় জেনারেল অরোরা হেলিকপ্টাযোগে কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ঐ সময় কুমিল্লা শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল স্তরের পুরুষ ও মহিলা ফুলের মালা হাতে করে রাস্তায় নেমে গেছে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাদের মালা দেয়ার জন্য।

 আমি এ সময় সাধারণ পোশাকে পরে বিমানবন্দরের গেটে এ দৃশ্য দেখছিলাম। এমন সময় জেনারেল অরোরা আমাকে ডেকে পাঠান। জেনারেল অরোরা আমাকে কুমিল্লা শহরের সম্পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা আয়ত্তে আনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি হেলিকপ্টারে পুনরায় চলে গেলেন। এরপরই জনতা আমাকে চিনতে পারল। জনতা আমার গলায় মেলা দেয়ার জন্য ভিড় জমালো। আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসলাম। ঐদিনই ৭ই ডিসেম্বর আমি শহরে এসেই সমস্ত সোনার দোকান সীল করে দিলাম। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ সরকার থেকে কোন রকম আদেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত পাক আমলের এস-পি, ডি-সিকে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিলাম।

 এ সময় কুমিল্লায় তেমন কোন পুলিশ ছিল না। এম-পিকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সেনারা সব সময় এগিয়ে আসত। তখনও পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে নাই। পাকসেনারা যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে, সেজন্য সতর্ক থাকার জন্য নাগরিকদেরকে আমি মাইকযোগে জানিয়ে দিলাম। বিমান আক্রমণ বা অনুরূপ ধরনের আক্রমণ হলে সবার বাড়িতে পরিখা খনন করার জন্য নির্দেশ দিলাম।

 ৭ তারিখ থেকে আমি আমার বাহিনী নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য ডিফেন্স নিয়েছিলাম এবং আক্রমণের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। কিন্তু ১৩ই ডিসেম্বর ভারতীয় হাইকমাণ্ড থেকে জানোনো হলো যে, কুমিল্লা সেনানিবাসে আক্রমণ করতে হবে না। জেনারেল অরোরা প্রচারপত্র বিলি করছেন এবং রেডিওতে ঘোষণা করছেন যাতে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই নির্দেশের পর আমি পাকসেনানিবাস