পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
154

গেলে আমরা এ্যামবুশ পেতে বসে থাকতাম এবং শত্রুরা এ্যামবুশের ফাঁদে পড়লে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের ধবংস করতাম। আমি তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতাম প্রায় রাতেই। ফলে শত্রুরা রাত্রিবেলা বাঙ্কার থেকে বাইরে আসতো না। এমন কি দিনের বেলা এক প্লাটুন শক্তি ছাড়া তারা বের হতে চাইত না।

 একদিন পাকসেনারা আমার ডানপাশের সাবসেক্টর মনতলির সাবসেক্টর কমাণ্ডার আইনউদ্দিনের বাহিনী দ্বারা এ্যামবুশ ফাঁদে আটকা পড়ে আক্রান্ত হয়। শত্রুদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তারা আহত এবং নিহত সৈন্যদের ১টা রেলওয়ে ট্রলিতে ভর্তি করে রেললাইনের ধার দিয়ে পালাতে থাকে। আমি তালতলা আড়াইবাড়ীতে এ্যামবুশ পেতে তাদের উপর আক্রমণ চালাই। আবার আক্রান্ত হবার ফলে তারা তাদের আহত ও মৃত সাথীদের ফেলে পলায়ন করে। পরবর্তী সময়ে পাকসেনারা তাদের মৃত সাথীদের কবর দেয়ার জন্যে গঙ্গাসাগরের এক কবরস্থানে জড় হয়েছে। আমার কয়েকজন গুপ্তচর এসে আমাকে এ খবর জানায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে দেখতে পাই সত্যিই শত্রুরা কবরস্থানে জড় হয়েছে তাদের সাথীদের কবর দেবার জন্য। আমি ৩” মর্টার এবং ভারী মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুদের উপর আকস্মাৎ গোলাগুলি ছুড়তে থাকি। ফলে পাকসেনারা তাদের পুরাতন মৃত সাথীদের সঙ্গে আরো কয়েকজন নতুন সাথীকে কবর দেয়।

 পাকসেনারা তাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে কুটি সড়কের উপরে এবং মূল ঘাঁটি স্থাপন করে আড়াইবাড়িতে টি, আলীর বাড়িতে। সে সময়ে সমগ্র শালদা নদী এলাকা নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণে চিল। তারা শালদা নদী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং সেজন্য এক কোম্পানী সৈন্যকে আড়াইবাড়ি থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে শালদা নদীর দিকে এগোতে থাকে। মনোলোবাগ রেলওয়ে স্টেশনের নিকট একটা প্লাটুন আগে থেকেই রেখেছিলাম। যখন শত্রুরা মনোলোবাগ রেলওয়ে স্টেশনের পাশের গ্রামে পৌঁছায়, তখন তারা আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একটি জীপ এম ৩৮ এআই, একটি ৩/৪ টনের ডজ ধ্বংস করে দেই। একজন অফিসারসহ ১৭জন নিহত হয় এবং ২০ জনের মত আহত হয়। আমরা গাড়ি নিয়ে আসতে পারিনি, কেননা শত্রুরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করছিল। ফলে গাড়িগুলি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরে আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, টেলিফোন ক্যাবল, শত্রুদের শুকনা রেশন, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করি। শত্রুদের বিছানাপত্র উড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা একটা স্যুটকেস পাই গাড়ির ভিতর থেকে। স্যুটকেসটি টাকা ভর্তি ছিল কিন্তু টাকাগুলি গোলাগুলির ফলে পুড়ে গিয়েছিল। আমি সমস্ত কিছু আমার সেক্টর কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে তুলে দেই। ঐ টাকা ভর্তি সুটকেসটি দেখে আমাদের ধারণা হয় ঐ পাকিস্তানী অফিসারটি এসব টাকা ব্যাংক থেকে লুট করেছিল। পরে তারা বারবার চেষ্টা করেছিল শালদা নদীর অবস্থান দখল করার কিন্তু তারা বারবারই পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যায়।

 সমগ্র কসবা ও শালদা নদী এলাকা জুলাই মাস পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণের ছিল। লাটুমুড়া পাহাড়ী জায়গাটি আমার নিয়ন্ত্রণে রাখি। শত্রুরা যদি লাটুমুড়া দখল করে নেয়, তবে ক্ষতি হবে। সেজন্য আমি একটি কোম্পানী তৈরী করে দুটি প্লাটুন সেখানে রাখি প্রতিরক্ষাব্যূহ শক্তিশালী করার জন্য। ফেনী মুন্সিরহাটে যাবার আগে কসবা সাব-সেক্টরের ভার ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে দিয়ে যাই।

 ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের (বর্তমানে মেজর) অধিনায়কত্বে মুন্সিরহাট ফেনী সাবসেক্টর একটা গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাকর স্থান হয়ে দাঁড়ায়। ফেনী থেকে তিন মাইল দূরে ছাগলনাইয়া, মুন্সিরহাট ও লক্ষ্মীপুরে ১৭ মাইল লম্বা এবং ৮ মাইল প্রস্থ এই বিরাট অবস্থান জুড়ে বসে আছেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও তাঁর বাহিনী। পাকসেনারা এ অবস্থানের উপর বিরাট শক্তি নিয়ে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার দু'জন অফিসার ও তিনটি কোম্পানি নিয়ে শত্রুদের কামান ও ট্যাঙ্কের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে ফেনী মুন্সিরহাট অবস্থান রক্ষা করা এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ মূহুর্তে এখানে