পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
155

আরো শক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাত দু'টার সময় মেজর খালেদ আমার ক্যাম্পে আসেন। আমি তখন ক্যাম্পে ছিলাম না, অপারেশনের জন্য বাইরে ছিলাম। যখন এ্যাকশন করে ফিরে আসি তখন দেখি তিনি ফেনীর একটা ম্যাপ খুলে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তাঁকে খুব চিন্তিত এবং বিষন্ন দেখাচ্ছিল।

 তিনি ধীরে এবং দ্রুত ফেনী অবস্থানের পরিস্থিতির কথা বলে গেলেন এবং কি করা যায় তার একটা পরামর্শ চাইলেন। একটা কোম্পানী ফেনীতে দ্রুত পাঠিয়ে দিতে তাঁকে অনুরোধ করলাম। মেজর খালেদ আমাকে একটা কোম্পানীসহ সেখানে যাবার জন্য বললেন। আমি এটা আগেই বুঝেছিলাম কিন্তু কসবার ভার কার হাতে দেয়া যায় এ নিয়ে একটু দ্বিধা ছিল। কেননা কোন নতুন অফিসারের পক্ষে কসবা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর ছিল না। যা হোক ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আমার ১নং কোম্পানী ও কসবা সাবসেক্টরের ভার দিয়ে আমি সকালে একটি কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে রওনা হই। যাবার সময় আমার ২নং কোম্পানীকে সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি। আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকেও সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি এবং লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে বলি। এ জায়গাটা ছিল পাহাড়ের উপর। এখান থেকে সমগ্র স্থান নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ ছিল। পাকসেনারা এ স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাবে। কেননা এর আগে তারা অনেক বার চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেনি। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার আমার কসবা ছেড়ে যাবার পর এক সপ্তাহের মধ্যে শত্রুরা লাটুমুড়া দখল করে নেয় এবং ১নং কোম্পানীর কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা এতে মারা যায়। নভেম্বর মাস পর্যন্ত পাকসেনারা লাটুমুড়ার উপর কর্তৃত্ব রেখেছিল। ভারত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে নভেম্বর মাসে শত্রুদের সরিয়ে দিতে পারা যায়। শত্রুদের সরাতে ৩ জন অফিসারসহ ৪০জন সৈন্য মারা যায় এবং ৬০ জনের বেশি আহত হয়। লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব এ হতাহতের থেকেই বুঝা যায়। শত্রুদের কতজন মারা গিয়েছিল তা আমার জানা নাই।

 যাই হোক, পরের দিন সকালে ২নং কোম্পানীকে সাথে নিয়ে ফেনীর পথে রওনা দিই। ৬ই জুন সন্ধ্যা ৫টার সময় বেলুনিয়া পৌঁছি। তারপর ১৪ মাইল কাদামাটির রাস্তা ভেঙ্গে আমি এবং আমার সৈন্যরা রাত ৮টার সময় মুন্সিরহাট নুতন বাজার পৌঁছি, যা জাফর ইমামের অবস্থান থেকে ৮০০ গজ দূরে ছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা কোন বিশ্রাম নেইনি এবং পেটেও কিছু পড়েনি। আমার কোম্পানীকে আমি এখানে বিশ্রাম নিতে বলি। তারপর আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর ক্যাম্পের দিকে রওনা হই। তাঁর সাথে দেখা করে অবস্থানটি দেখি। প্রতিরক্ষাব্যূহ দেখে আশ্চর্যবোধ করি। প্রতিরক্ষাব্যূহ খুব শক্তিশালী ছিল না। মূল অবস্থানের ডানদিক একেবারে ফাঁকা এবং খোলা অবস্থায় ছিল। বাঁয়ে অবস্থানরত লেঃ ইমামুজ্জামানের বাহিনীর সাথে জাফর ইমামের বাহিনীর দূরত্ব অনেক ছিল। এত দুর্বল অবস্থানের জন্য আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে দোষ দিতে পারি না কেননা সৈনসংখ্যা ছিল সীমিত। যাহোক প্রতিরক্ষাব্যূহকে সুদৃঢ় করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে বলি।

 (ক) আমার কোম্পানী থাকবে অবস্থানের ডানদিকে। দুটি প্লাটুন উপরে এবং ১টি প্লাটুন ভিতরে।

 (খ) ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনী তাঁর অবস্থানেই থাকবে কিন্তু সৈন্যদের আরো সংগঠিত করতে হবে। ডিফেন্স ভিতরেই নিতে হবে।

 (গ) লেঃ ইমামুজ্জামান বায়ে থাকবে কিন্তু দুরত্বটা কমিয়ে আনতে হবে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর সাথে সংযোগ রাখতে হবে।

 (ঘ) মুন্সিরহাটের নিকটে মূল অবস্থানের সাথে সংযোগ রেখে ক্যাপ্টেন শহীদের বাহিনী অবস্থান নেবে।

 কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার পরিকল্পনা মেনে নেয় না। আমি এরপর মেজর আমিনের কাছে যাই এ ব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্য। মেজর আমিন তখন ঐ অঞ্চলের কমাণ্ডার ছিলেন। মেজর আমিন ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বুঝতে সক্ষম না হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। মেজর খালেদ তখন সেখানে ছিলেন না।