পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
158

থেকে মুহুরী নদীতে যে প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল তা সন্ধ্যায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যোগাযোগের অভাব হেতু সে এ খবর আগে পাঠাতে পারেনি। প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে যাওয়ায় সে ফুলগাজির দিকে চলে যাচ্ছে। আমি আমার ডানপাশের বাহিনীকে অবস্থান তুলে নিয়ে মুহুরী নদী হয়ে ফুলগাজিতে অবস্থান নিতে বলি।

 রাত ৯টার দিকে আমার হেডকোয়ার্টার কামাণ্ডোদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাঠাননগর হয়ে অগ্রসরমান শত্রুসেনারা বাঁ দিক এবং সামনের দিক দিয়ে আক্রমণ চালায়। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠায় ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান তুলে নিয়ে ফুলগাজির পিছনে চিতলিয়ায় অবস্থান নিতে বলেছেন। ঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, অন্যথায় আমরা সবাই শত্রুদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম।

 পাক কমাণ্ডো এবং অন্যান্য সৈন্যরা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমি দেখতে পেলাম শত্রুরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেক গ্রুপে ২০/৩৫ জন শত্রুসেনা ছিল। বাঁ দিকের গ্রুপটি ২০/৩৫ গজ দূরে এবং অন্যটি ৩০/৪০ গজ দূরে। আমি এবং আমার সৈন্যরা সবাই একসাথে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তারাও আমাদের উপর গুলি চালাতে লাগল। গোলাগুলি বিনিময় আটঘণ্টা ধরে চলল এবং শত্রুরা ৮টা মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছনে সরে যেতে লাগল।

 ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দুজন গুরুতরভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য আমার নিকট পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে পৌঁছানোর কোন দ্রুত ব্যবস্থা ছিল না। আমি তাদেরকে আরও ১২ জন আহত মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে রেখে দেই। এরিয়া কমাণ্ডার মেজর আমিন ফুলগাজী থেকে আমার হেডকোয়ার্টারে আসেন। আমি তাঁকে আমার অবস্থানের দ্রুত অবনতির কথা জানাই। তিনি দ্রুত আহত সৈনিকদের পশ্চাৎবর্তী ঘাঁটি ফুলগাজী-চিতলিয়াতে পৌঁচানোর ব্যবস্থা করেন। আহত সৈনিকদের উপর যাতে হামলা না হয় তার জন্য তাদের সাথে একটা প্রহরা (এসকট) পার্টিও দেই।

 তখন রাত সাড়ে দশটা। যুদ্ধ কিছু সময় হল থেমে আছে। যতদূর সম্ভব শত্রুরা সে সময় শক্তি সঞ্চয়ে ব্যস্ত ছিল। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর ও তাঁর বাহিনীর অবস্থান তুলে নিয়ে আমার কাছে আসেন। আমরা তাড়াতাড়ি দ্রুত পরিস্থিতি অবনতির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিই আমি আমার অবস্থানে থাকব এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম সৈন্যদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে সরে যাবেন। সেই অনুযায়ী তিনি ফুলগাজীর দিকে রওনা দিলাম। ভোর ৪ টার মধ্যে সমস্ত সৈন্য ফুলগাজীতে চলে যায় এবং আমি ভোর সাড়ে ৫টার সময় আমার অবস্থান পরিত্যাগ করে ফুলগাজীর দিকে রওনা দেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী ঘাঁটিতে যাওয়াটা খুব সুন্দরভাবে হয়েছিল। সকালে ফুলগাজীতে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়। তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। ফুলগাজী অত্যধিক ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এখান থেকে শত্রুদের মোকাবিলা করা অসম্ভব ছিল, ফলে আমরা চিতলিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নেই। যাবার আগে ফুলগাজীর ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে একটা ডিলেইং পার্টি এবং চিতলিয়া আসি এবং নতুন অবস্থান তৈরী করি। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলাবোর্ড সড়ক এবং রেললাইনের উপর অবস্থান নেই। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর বাহিনী নিয়ে পরশুরাম এলাকায় অবস্থান নেন। বাঁ দিকে একটা প্লাটুনকে মোতায়েন রাখি এবং আমার বাঁ দিকে মুহুরি নদী বরাবর লেঃ ইমামুজ্জামান তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন। এভাবে আমরা দ্রুত চিতোলিয়াতে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।

 ইতিমধ্যে পাকসেনারা ফুলগাজী ব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি আমি ফুলগাজী ব্রীজ শত্রুদের এগোতে বাধা দেয়ার জন্য ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এ ব্রীজে এসে শত্রুরা বাধা পায় এবং ২৪ ঘণ্টারও বেশী সময় পর্যন্ত তারা আর এগোতে পারেনি। ৪৮ ঘণ্টা যাবৎ শত্রুদের এগোতে বাধা দিতে থাকি, ফলে শত্রুরা অধিক গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তাতেও ব্যর্থ হয়ে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্রীজের এপারে আসে। চিতলিয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে শত্রুরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে মুহুরী নদী পার হয়ে আসে এবং