পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
168

কমাণ্ডার বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৪র্থ বেঙ্গল এবং মুজিব ব্যাটারীকে (বাংলাদেশের প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী) নিয়ে আমি হিয়াকু, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট হয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাবে এবং ১০ম বেঙ্গল ও আরও দুটো ভারতীয় ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপ সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হবেন। পরিকল্পনা নেয়া হয় চট্টগ্রমে একসঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা একসঙ্গে চট্টগ্রামে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পরিকল্পনা মত আমরা রাত ১২টার সময় রওনা দিলাম এবং সকাল সারে ৬টায় হিয়াকু বাজারে পৌছালাম। হিয়াকু বাজারে শত্রুদের একটা ডিলেয়িং প্লাটুন ছিল। তারা আমাদের বাধা দেয় কিন্তু আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলির জন্য তারা অবস্থান তুলে নিয়ে ফটিকছড়িতে পালিয়ে যায়। আমরা হিয়াকু সহজেই শত্রুমুক্ত করি। এরপরে রাস্তা ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল। কোন কোন সময় আমাদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। অগ্রসর হবার পথে বিবিরহাটের এবং হিয়াকুর মধ্যে চৌরাস্তার সামনে এক পাঞ্জাবী সেনা হাত তুলে আমাদের আসতে বলে। আমি আমার গাড়ি এ শত্রুসেনাটির উপর দিয়ে চালিয়ে দিই। এতে সে গুরুতরভাবে আহত হয় এবং চিকিৎসা করার জন্য পাঠাবার সময় পথিমধ্যে সে মারা যায়। শত্রুসেনাটি পথ হাড়িয়ে ছিল বলে আমার মনে হয়। নারায়ণহাটে শত্রুদের একটা ডিলেয়িং পার্টি ছিল। তারা আমাদের আক্রমণে পিছু হটে ফটিকছড়িতে চলে যায়। নারায়ণহাটে এক রাত থাকি এবং বাহিনীকে আরো সংগঠিত করে পরের দিন সকালে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হই। পথে কাজিরহাটে দেখি একটা কাঠের ব্রীজ শত্ররা ভেঙ্গে দিয়েছে। ব্রীজ মেরামতের জন্য আমাদের ৫/৬ ঘণ্টা সময় লাগে। কাজিরহাটে শত্রুরা আমাদের অগ্রসরে বাধা দেবার জন্য পথে অনেক মাইন বসিয়ে রেখে গিয়েছিল। এসময়ের মধ্যে আমরা মাইনও সরিয়ে ফেলি এবং আমরা ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি।

 ফটিকছড়িতে শত্রুদের এক কোম্পানী ই-পি-সি-এ-পি ও ২৪তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের কিছু সৈন্য মোতায়েন ছিল। কাজিরহাট থেকে কিছুদূর এগিয়ে আমি আমার বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করে শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেই। একদল ফটিকছড়ির সন্নিকটে পাহাড়ের দিকের রাস্তায় অবস্থান নেয়। আর একদল মানিকছড়ি রামগড় রাস্তার এক জায়গায় অবস্থান নেয়। প্রধান দলটি ফটিকছড়ি কাজিরহাট রাস্তার শত্রুদের অবস্থানের নিকট অবস্থান নেয়। প্রধান দলটি ফটিকছড়ি-কাজিরহাট রাস্তার শত্রুদের অবস্থানের নিকট অবস্থান নেয়। ১১ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের সময় আমরা সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। শত্রুরা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ বিছানাপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। ফটিকছড়ি রক্ষার জন্য শক্তিশালী অবস্থান নিতে বলি। সেই প্রধান চারটি সড়কের সামনে আমরা অবস্থান নেই। ফটিকছড়ির যুদ্ধে আমাদের দুইজন আহত হয়। পাকসেনাদের কতজন মারা গিয়েছিল তা জানা না গেলেও তাদের রক্ত মাখা জামা-কাপড় অনেক ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমি মনে করি তাদের বেশ কিছু হতাহত হয়েছিল। এরপর শত্রুরা পিছু হটে নাজিরহাট থেকে আমাদের উপর মর্টারের সাহায্যে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এর মধ্যে একজনের মারফত খবর পাই শত্রুরা রামগড়ে তাদের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে মানিকছাড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমি আরো দুটো প্লাটুনকে মানিকছড়ি রাস্তায় আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার জন্য পাঠিয়ে দেই এবং মর্টারের সাহায্যে রামগড়ে শত্রুদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। এতে তারা মানিকছড়ির দিকে না এগিয়ে অন্য পথে নাজিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়।

 এরপর আমি নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থান দেখার জন্য নাজিরহাটের দিকে যাই। নদীরপারে এক দোতলা বাড়ি থেকে শত্রুদের অবস্থান রেকি করি এবং দেখি শত্রুরা নদীর ধার বরাবর শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বসে আছে। মেজর আসিফের নেতৃত্বে ৩৪তম এফ-এফ-রেজিমেণ্টের ২টা কোম্পানী ও বেশ কিছুসংখ্যক ই- পি-সি-এ-পি নাজিরহাটে অবস্থান নিয়েছিল। ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় থেকে আমরা নদীর পার থেকে নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকি। আমাদের লক্ষ্য ছিল এ আক্রমণে শত্রুরা যদি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে তাহলে আমরা সাঁতরিয়ে নদী পার হয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু তাদের অবস্থান এত শক্তিশালী ছিল যে আমরা চারঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চালাবার পরও তারা আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে।