পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
169

তখন বুঝতে পারি এভাবে আক্রমণ করে কোন লাভ হবে না। চারঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর আমি আমার বাহিনীকে উঠিয়ে নেই। এই সংঘর্ষ চলবার সময় আমরা একজন রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। সে আমাকে জানায় উদালিয়া চা-বাগান থেকে শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা এঁটে উঠতে পারবে না। সেই মত আমি উদালিয়া হয়ে শত্রুদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেই। আমি লেঃ শওকতকে গণবাহিনীর ১টা কোম্পানী নিয়ে নাজিরহাট ও চট্টগ্রমের মধ্যকার একস্থানে অবস্থান নিতে বলি। সে আমার কথামত অবস্থান নেয়। আর একটা কোম্পানীকে নাজিরহাট-চট্টগ্রাম রেললাইনের মাঝে একস্থানে। অবস্থান নিতে বলি। তারাও আমার নির্দেশ মত অবস্থান নেয়। বার ঘণ্টা যুদ্ধ চালাবার পর অবস্থান তুলে নিয়ে আমি আমার লোকদের খাইয়ে নিয়ে উদালিয়ার দিকে অগ্রসর হই। রাতের মধ্যে অবস্থান ঠিক করে নিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে নাজিরহাটে শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ করি। তারা এত হকচকিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা আমাদের আক্রমণে বাধা পর্যন্ত দিতে পারেনি। তারা ভেবে ছিল অবস্থান তুলে নেবার পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আমাদের কম পক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। আমরা ভোরে যখন আক্রমণ চালাই তখন অনেকেই ঘুমাচ্ছিল। শত্রুরা ঘুম থেকে উঠে যখন তাড়াতাড়ি অবস্থান তুলে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন পলায়নপুর পাকসেনাদের উপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালান হয়। এতে তাদের অনেক হতাহত হয়। ২৭ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। ৮ জন আহত সৈনিককে ধরা হয়। ৪৯ জন ই-পি-সি-এ-পি আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ, জিনিসপত্র, ১টা বেডফোর্ড ট্রাক (রেশন বোঝাই) আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা যখন পালাচ্ছিল, তখন পথে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত লেঃ শওকতের গণবাহিনীর কোম্পানী ও রেলসড়কের কোম্পানী শত্রুদের পলায়নে বাধা দেয়। কন্তু পাকসেনারা রেললাইন ও সড়কের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৪ই ডিসেম্বর নাজিরহাট মুক্ত হয়। এতে আমাদের একজন শহীদ ও চারজন আহত হয়। নাজিরহাটের ব্রীজটি মেরামত না করা পর্যন্ত আমি মর্টার, ভারী কামান, অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ি পার করতে পারছিলাম না। নাজিরহাটের বেসামরিক লোকের সাহায্যে ব্রীজটি পুনঃনির্মাণ করিয়ে মর্টার, গাড়ি পার করিয়ে নেই।

 নাজিরহাট মুক্ত করার পর আমি আমার বাহিনী পুনর্গঠিত করে হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হই। ১৫ই ডিসেম্বরের সকালে হাটহাজারী পৌঁছে ওখানে মেজর জাফর ইমামের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি সিতাকুণ্ড হয়ে ব্যাটালিয়ন নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। তারপর সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে রেকি করে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হই। এমন সময় ‘কে’ ফোর্সের ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপ ওয়ারলেসের মাধ্যমে নির্দেশ দেন পুনরায় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আক্রমণ বন্ধ রাখতে। বিকেল ৪-৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা তাদের সমস্ত ব্যাজ, অস্ত্রশস্ত্র ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপের নেতৃত্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্ট, নেভাল বেইস ও ট্রানজিট ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। জনগণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে এবং জয়োল্লাসে শহর ভ্রমণ করতে থাকে।

 সর্বশেষে বলতে চাই তাদের কথা- যারা আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। মন্দভাগ ও শালদা নদী সাবসেক্টরে আমাকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, কর্নেল খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন মহসীনউদ্দিন আহমেদ, লেঃ এ কে ফজলুল কবির, ক্যাপ্টেন ডাঃ আক্তার হোসেন, লেঃ মোস্তফা কামাল, সুবেদার আঃ ওহাব, নায়েব সুবেদার বেলায়েত (শহীদ), সুবেদার শহীদ, সুবেদার আম্বিয়া (বিডিয়ার), নায়েব সুবেদার আসাদ্দর আলী (বিডিয়ার) সুবেদার আবদুর রহমান, নায়েব সুবেদার মনির হোসেন, সুবেদার মেজর আঃ জববার, সুবেদার মেজর মোঃ হোলাল উদ্দিন, নায়েব সুবেদার মোঃ হোসেন, নায়েব সুবেদার মঈনুল হোসেন, (শহীদ) নায়েব সুবেদার সিরাজ, সুবেদার ফরিদউদ্দিন (বিডিয়ার), পুলিশ