পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
174

 বেসামরিক লোকেরা আমাদের সার্বিকভাবে সাহায্য করে। চাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র তুলে আমাদের জন্য নিয়ে আসতো। তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতও ছিল। জুন মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী ১৫/১৬টি গাড়ি করে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রায় দেড়শত সৈন্য দু'টি ভাগে ভাগ করে নেই- ডেপথ-এ মেজর জাফর ইমাম এবং আমি সামনে। আমি ভারী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করি। পাকবাহিনী ৫০০ গজের মধ্যে চলে আসে। আমি সামনে থেকে ওদেরকে বেশ দেখতে পাচ্ছি। সারাদিন যুদ্ধ হবার পর পাকবাহিনী ফিরে যায়। ওদের পক্ষে ৬০/৭০ জন মরতে দেখি। অদেখা আরও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তবে সামরিক সূত্রে অনেক লোক মারা গেছে শুনলাম। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। জুলাই মাসের প্রথমেই পাকবাহিনী প্রচণ্ড আর্টিলারী এবং বহু সেনা নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে থাকি। আমি আগে, তার পাশে একটি এবং আমার পিছনে একটি রাখি আমার সাহায্যের জন্য। আমরা যখন ফায়ারিং শুরু করি তখন পাকবাহিনী আমাদেরকে সামনে ব্যস্ত রেখে দুদিকে দুটো কোম্পানী ঘিরে ফেলতে থাকে। আমরা কিছুই জানতাম না। প্রায় পাশাপাশি যখন এসেছে তখন ওরা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা আমাদের বিপদ বুঝতে পারি। সামনে দুএকজন সৈন্য সামান্য অস্ত্র রেখে বাকি সবাইকে আস্তে আস্তে পিছনে হাটতে বলি। আমরা যে পিছনে হটছি তা ওরা বুঝতে পারেনি। কারণ দু'একজন অনবরত গুলি করেই যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পিছনের দলটি আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। আমি তাকে বাধা দিয়ে পিছনে সরে যেতে বলি। আমরা পিছনে একটি ভাল জায়গা দেখে পুনরায় ঘাঁটি গাড়ি। পাকবাহিনী এগিয়ে আসে পুল অতিক্রম করে। পাকসেনারা বাঁশপাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম ছাগলনাইয়া, বেলুনিয়া, ছাগলনাইয়া, বাজার, কুমা সমস্ত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহু মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, মারধর করে। বহুকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা পিছনে গিয়ে সবাই একত্র হয়ে ওদের উপর আক্রমণ করি তখন ওরা আর অগ্রসর হয়নি। জুলাই মাসেই আবার পাকবাহিনী আক্রমণ করে। দু'দিন ধরে যুদ্ধ হয় সবসময়। আমরা যেতে পারিনি, এমনকি পানি খাবারও অবসর ছিল না। সবসময় ব্যাপকভাবে ফায়ারিং চলছিল। আমরা টিকতে না পেরে পিছু হটি এবং ছাগলনাইয়ার বিওপিতে দীঘির ধারে ঘাঁটি গাড়ি। দু'তিন দিন পর আবার সংঘর্ষ হয়। এখানেও আমরা টিকতে পারিনি, তারপর সমরগঞ্জের দ'তিন মাইল দক্ষিনে আমাদের সামরিক ছাউনি ছিল- ওখানে চলে যাই। ওখানে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেই। কারণ এক মাস যাবৎ গোসল ছিল না, খাওয়া দাওয়া পায় তেমনি আছে। জুলাই/আগস্ট মাসে আমরা আবার মধুগ্রামে পজিশন নেই। শুভপুর এবং ছাগলনাইয়ার মাঝামাঝি স্থান ছিল মধুগ্রাম। ১৫/১৬ দিন ওখানে ছিলাম। একদিন পাকবাহিনীর একটি টহলদার পার্টিকে যারা ট্রাকে করে এসেছিল আক্রমণ করে সম্পূর্ণ শেষ করে দেই।

 ওখানে দু'তিন দিন থাকি। তারপর আর একদিন আমরা পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলাম। সামনে মেজর (বর্তমান কর্নেল) জিয়ার বাহিনী, পেছনে আমার। পাকবাহিনীর সামনের দলকে সম্পূর্ন ঘিরে ফেলে এবং এই সংঘর্ষে আমাদের বহু সৈন্য শহীদ হয়। আমরা যখন খবর পাই তখন আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি- আমরা পিছু হটে সামরিক ছাউনিতে ফিরে আসি।

 আমরা আবার মধুগ্রামে অবস্থান নেই। তারপর সেখান থেকে মুন্সিরহাট। সমগ্র এলাকাটিকে কেন্দ্র করে আমরা পজিশন নেই। কুতুবপুর জাম্পপুরা বেলুনিয়া রেলওয়ে পর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিল। মাসটি বোধহয় আগস্ট হবে। ৩/৪ দিন বাঙ্কার করতে চলে যায়। সামনে একটি সেকশন রাখি। বন্দুরা পুলের ওখানে একটি ছোট টিম রাখি। একদিন সকালে পাকসেনারা পুল অতিক্রম করে যাচ্ছিল। আমরা হঠাৎ আক্রমণ করে ১০/১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করি। পাকসেনারা ফিরে গিয়ে অধিক শক্তি নিয়ে পুনরায় আসে। আমরা পুরো রাস্তা মাইন পুতে রেখে ছিলাম- যাতে ট্যাঙ্ক পর্যন্ত আসতে না পারে। কিন্তু তবুও পাকবাহিনী আক্রমণ চালালো। ১০টার দিকে আক্রমণ করে। পাকবাহিনী ইয়া আলী বলে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরা সামনা সামনি ওদের দেখছিলাম। বহু পাকবাহিনী মারা যায় তবুও সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা ছাড়েনি। আমাদের ৫/৬ জন শহীদ হলো। কিছু আহত হয়। ওদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। আমার সাথে লোকমান বলে এক সিপাই ছিল